কর্ডোভার সোনালি যুগের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসাবিদ আবুল কাসিম আল-জাহরাভি, যিনি পৃথিবীকে উপহার দেন তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আত-তাসরিফ’। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে, আল-জাহরাভি স্পেনের আরব চিকিৎসাবিদদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শল্যবিদ ছিলেন। ইউরোপে তিনি আল-বুকাসিস (Albucasis), বুকাসিস (Bucasis) ও আল-য়্যারভিয়াস (Alyaharvious) নামে পরিচিত।
পুরোনাম:
আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আল-আব্বাস আল-জাহরাবি ।জন্ম:
৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসিয়ার আজ-জাহরা শহরে আল-আনসারি গোত্রে তাঁর জন্ম। এই শরহটি কর্ডোবা থেকে 8 কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম অবস্থিত।শৈশব ও শিক্ষাদীক্ষা:
তার শৈশব এবং শিক্ষা সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমাদের হাতে নেই। যত দূর জানা যায়, জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি স্পেনের কর্ডোভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। খুব সম্ভবত মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে তিনি এল-জাহরা শহরে স্থানান্তরিত হন এবং বাকি জীবনটা সেখানেই কাটান।ইতিহাসবিদগণের মতে, তিনি তার আত্মজীবনী লিখে গিয়েছিলেন। তাছাড়া, তিনি জীবিত থাকা অবস্থায়ই তাকে নিয়ে আরো অনেক লেখা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, ক্যাস্টিলিয়ান ও আন্দালুসিয়ানদের মধ্যকার যুদ্ধে এল-জাহরা শহর ধ্বংস হয়ে যায়। সাথে তার ব্যক্তিগত তথ্যাদি পাবার রাস্তাও চিরতরে বন্ধ হয়।
বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবন:
তিনি কর্ডোবায় তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। শিক্ষা শেষে তিনি জাহরায় চিকিৎসাসেবা শুরু করেন।শল্যচিকিৎসায় প্রথম থেকেই তিনি আশ্চর্যজনক সফলতা লাভ করেন। ফলে দ্রুত সবদিকে তার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সফলতার স্বাক্ষর হিসেবে খলিফা আবদুর রহমান ও খলিফা আবুল হাকাম – উভয়েরই চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। কর্ডোভার বিখ্যাত হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক হিসেবেও নিয়োগ পান তিনি।আর এখানে থাকাকালীনই তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কিতাব আল তাশরিফ’ রচনার কাজ শেষ করেন। এই গ্রন্থ বদলে দিয়েছিল মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা। সে সময়কার মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জন্য তার ত্রিশ খণ্ডের এই বিশ্বকোষটি ছিল অক্সিজেনস্বরূপ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথ্যালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা- সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল আল তাশরিফের ত্রিশ খণ্ডে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই মহাগ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন আল জাহরাউয়ি। সে বছরই খলিফার সহায়তায় বইটি প্রকাশিত হয়। তার ভুবনবিখ্যাত চিকিৎসাগ্রন্থ ‘আত-তাসরিফ’র মতো বিষয়বস্তু ও তত্ত্বনির্ভর এতো চমৎকার গ্রন্থ তৎকালীন যুগে আর কেউ লিখেন নি।শল্যচিকিৎসা বিভাগের প্রভূত সংস্কার ও উন্নতি সাধন করেন তিনি।তিনি নিজেও মূলত একজন শল্যচিকিৎসকই ছিলেন। নিজের প্রিয় অধ্যায়কে সবার শেষ সংযোজন করা নিয়ে তার একটি বিখ্যাত মন্তব্য রয়েছে।
“চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে শল্যচিকিৎসা। একজন চিকিৎসক যতদিন না চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্য সকল শাখার সাথে যথার্থভাবে পরিচিত হয়ে উঠবেন, ততদিন তার শল্যচিকিৎসার দিকে যাওয়া উচিত নয়।”
শেষ জীবনে আবুল কাসিম সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। জীবনসায়াহ্নে তিনি চিকিৎসাগ্রন্থ প্রণয়নে মনোনিবেশ করেন। ব্যক্তিজীবনে জাহরাভি ছিলেন সাদাসিধে ও ‘অল্পে তুষ্টি’ প্রকৃতির। চিকিৎসাবিদ্যা ও ঔষধ তৈরি ইত্যাদির প্রতি ভীষণ ঐকান্তিক ছিলেন। গরিব-দুঃখী ও অসুস্থদের সেবায় নিজের অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন।
আল-জাহরাভির রচনা-সম্ভার:
পদার্থ, রসায়ন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর আল-জাহরাভি বিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থগুলোই তাকে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের মর্যাদা দেয়। চিকিৎসাবিষয়ক যে গ্রন্থটি তাকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি হলো “কিতাবুত তাসরিফ লিমান আজিযা আনিত তা’লিফ”। এই গ্রন্থটি ৩০টি অধ্যায়ে শিক্ষাগত (Educational) ও কার্যকরী (Effective) বিস্তৃত, যার প্রথম খণ্ডে এনাটমি (Anatomy), ফিজিওলজি (physiology) ও ডায়াবেটিকস (Dietetics) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে বিশেষত সার্জারি (Surgery) সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটিকে অধ্যাপক সারটন ‘Medical Encyclopedia’ নামে অভিহিত করেছেন। এর চিকিৎসার অংশের চেয়ে সার্জারীর অংশ সর্বদিক দিয়ে উন্নত ও মৌলিকতার পরিচায়ক হলেও চিকিৎসার অংশেও মৌলিকতার অভাব নেই। ঔষধ তৈরি করতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুসরণে পতন (Distillation) ও ঊর্ধ্বপাতন (sublimation) প্রথা প্রয়োগ করেছেন। এসব দিক বিবেচনায় গ্রন্থটিকে অভিনব বলা চলে। এছাড়াও গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ডে বা কার্যকরী-সার্জারি অংশে রয়েছে অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্যবলী।তার এই গ্রন্থ, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে ইউরোপের সকল বিখ্যাত মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় ৫ শতাধিক বছর প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।“যে ব্যক্তি শল্যচিকিৎসাকে জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করতে চান, তাকে অবশ্যই অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে।”- আল জাহরাউয়ি
তা কিছুতে প্রথম জাহরাভি:
ঐতিহাসিকদের মতে জাহরাভিই সর্বপ্রথম চিকিৎসক, যিনি ইউরোপে বৈজ্ঞানিক প্রথায় সার্জারির প্রচলন ও এর বিশদ বিবরণ প্রচার করেন। সার্জারি খণ্ডের বিশেষত্ব হলো- এর মধ্যে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনা করা হয়নি, ফলে এটা এমনিতেই পরিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ খন্ডটি পৃথকভাবে চিত্রাদিসহ প্রকাশিত হয়। ডা. ক্যাম্পবেলের মতে, “এ হলো এ বিষয়ের সর্বপ্রথম স্বাধীন সচিত্রগ্রন্থ”।সার্জারির ক্ষেত্রে এই মহান মনীষীর অপরিসীম ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাফল্য হলেও মেডিসিন বা ঔষধ বিষয়েও যথেষ্ট অবদান পাওয়া যায়। তিনি কুষ্ঠরোগ ও এর প্রতিকার সম্বন্ধে তাঁর গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। তিনি অবস্থা বুঝে এ রোগের চিকিৎসা করতেন। তিনি ই সর্বপ্রথম এ রোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেন।
জাহরাভি শিশু রোগের চিকিৎসাতেও কিছু কিছু অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোসেফালিক সমস্যার সমাধান করার কৃতিত্ব দেয়া হয় জাহরাউয়িকে। মানুষের মাথার ক্রেনিয়াল ক্যাভিটি থেকে ‘সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড’ বা সিএসএফ নামক একপ্রকার তরল নির্গত হয়, যা মস্তিষ্ককে ঘিরে রাখে। হাইড্রোসেফালিক সমস্যা তখন হয়, যখন এই সিএসএফ তরল মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে এটি খুলির মধ্যে জমা হতে থাকে এবং শিশুদের মাথার আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। কেননা শিশুদের খুলির অস্থিগুলো পরিপক্ক এবং একীভূত নয়। অন্যদিক প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার আকৃতি বাড়তে পারে না এবং প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এই সমস্যাকে অনেক সময় ‘মাথায় পানি জমা’ও বলা হয়।
জাহরাউয়ি তার গ্রন্থে এই সমস্যার অস্ত্রোপচারের কথা সবিস্তারে লিখেছেন।
“নবজাতক শিশুর মাথার খুলি এমনিতেই নানাবিধ তরলে পূর্ণ থাকে। মাথায় পানি জমতে থাকলে প্রতিদিন তার মাথার আয়তন বাড়তে থাকে। ফলে খুলির অস্থিগুলো একীভূত হতে পারে না। এ সমস্যার সমাধানকল্পে, খুলির মধ্যভাগে তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে কেটে উন্মুক্ত করতে হবে। জমে থাকা তরল নির্গত হয়ে গেলে ক্ষত সেলাই করে শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে, যেন খুলির অস্থিগুলো একীভূত হতে পারে।”- আল তাশরিফ; ৩০তম খণ্ড
তিনি শিশু রোগের চিকিৎসার জন্য মাতৃস্তন থেকে দূষিত দুধ চুষে বের করার পরিবর্তে এর জন্য এক প্রকার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। শিশুদের রিকেটস হবার কারণ এবং এর প্রতিকারেরও এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি শিশুদের মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়ার কারণ সম্বন্ধে পূর্বেকার সব মতের ওপর নতুন মত প্রকাশ করেন।
চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম এক্টোপিক গর্ভধারণ নিয়ে বর্ণনা করেছেন। হায়মোফিলিয়াকে তিনি সর্বপ্রথম বংশগত বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন।
জিরাল্ড কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ:
‘আত-তাসরিফ’ গ্রন্থের সার্জারী খণ্ডটি জিরাল্ড ল্যাটিন ভাষায় মূল আরবিসহ প্রকাশ করেন। ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে গ্রন্থটির নাম দেয়া হয় ‘De Chirurgia’। এটি সালার্নো ও মন্টেপেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এ গ্রন্থ ২০০ প্রকার সার্জারির যন্ত্রপাতির নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গ্রন্থটি ইউরোপে কি পরিমাণ মর্যাদা লাভ করেছে, তা এর বারবার অনুবাদ থেকেই বোঝা যায়। ডা. ক্যাম্পবেলের মতে, গ্রন্থটি পরপর পাঁচবার ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। আর একথা সর্বসম্মত যে, তার এ গ্রন্থের প্রভাবেই ইউরোপে সার্জারির মান বিশেষভাবে উন্নীত হয়।আল-জাহরাভির চিকিৎসাগ্রন্থের যে কয়েকটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, তন্মধ্যে দুইটি রয়েছে অক্সফোর্ডের বডলিয়েন (Bodleian) লাইব্রেরিতে এবং অন্য একটি রয়েছে গোথাতে। জিরাল্ডের ল্যাটিন অনুবাদের একটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে প্যারিসে। এতে তিনি গ্রন্থকারের নাম দিয়েছেন Abul Casim। কিছু পাণ্ডুলিপি ফ্লোরেন্স, ব্যামবার্গ, ফ্রাঙ্কয়েস, মন্টেপেলিয়ার, লিডেন ও ডেনিস রক্ষণাগারে সুরক্ষিত আছে।
ইউরোপিয়ানদের মূল্যয়ান:
“আবুলকাসিসের চিকিৎসাপদ্ধতি এতটাই উন্নত ছিল যে সেগুলোর কাছে গ্যালেনের চিকিৎসাপদ্ধতিও হয়ে যায়! ইউরোপীয়রা অন্ধের মতো অনুকরণ করতে শুরু করে তাকে। তার দেখানো পথে চলেই ইউরোপে শল্যচিকিৎসা আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে!” – চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসবিদডোনাল্ড ক্যাম্পবেল
তথ্য সুত্র:
1. আকবর আলী, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, পৃষ্ঠা: ৩৩৯)
2. al-Zahrāwī, Abū al-Qāsim Khalaf ibn ʻAbbās (১৯৭৩)। مقالة في العمل باليد: A Definitive Edition of the Arabic
3. ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোর্স
4. উইকিপিডিয়া
লিখেছেন— Raqib Hussain