মধ্যপ্রাচ্যের চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক:
নাম:আবু ʿআলী আল-হোসাইন বিন ʿআব্দিল্লাহ ইবনুল হাসান বিন ʿআলী ইবনে সীনা। (আরবি: أبو علي الحسين بن عبد الله بن الحسن بن علي بن سينا;জন্ম: ৯৮০খ্রিস্টাব্দ – জুন ১০৩৭),
তবে তিনি ইবনে সিনা (ফার্সি: ابن سینا) নামে পরিচিত।।, এছাড়াও আবু আলী সিনা (ابوعلی سینا), পুর সিনা (پورسینا) বা পাশ্চাত্যে আভিসেনা (লাতিন: Avicenna; /ˌævɪˈsɛnə, ˌɑːvɪ-/) নামেও পরিচিত।
তিনি ছিলেন একজন পারসিক।যাঁকে ইসলামি স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চিন্তক,
লেখক এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক গণ্য করা হয়। তর্কসাপেক্ষে প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক।
তিনি গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত একজন পেরিপেটিক দার্শনিক ছিলেন।
ধারণা করা হয় তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাসহ মোট ২৪০টি গ্রন্থ বর্তমানে টিকে রয়েছে
জন্মস্থান:আফশোনা, বোখারা, সামানি সাম্রাজ্য (অধুনা উজবেকিস্তান)
মৃত্যু:২২ জুন ১০৩৭ (বয়স ৫৬–৫৭)।
হামাদান, কাকুঈ সাম্রাজ্য (অধুনা ইরান)
ধারা:
আরিস্তুবাদ, ইবনেসিনাবাদ
আগ্রহ:
চিকিৎসা বিজ্ঞানসুগন্ধ চিকিৎসাদর্শনঅধিবিদ্যানৈতিকতাযু
ভাবগুরু
হিপোক্রেটিসএরিস্টটলগালেননয়াপ্
ভাবশিষ্য
আল-বিরুনীওমর খৈয়ামইবনে রুশদইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দীনাসিরুদ্দীন তুসীইবনুন নাফিসইবনে তুফায়েলর্যনে দেকার্তআলবার্টাস মাগনাসমুসা বিন মৈমুনজন ডান্স স্কোটাস]টমাস আকুইনাসঅকহামের উইলিয়ামআবু উবাইদ জুজজানিআলোকিত যুগের দার্শনিকগণ সৈয়দ হোসেইন নসর
সমাধিস্থল
ইবনে সিনার মাজার, হামাদান, ইরান
ধর্ম:
ইসলাম।তবে তার মতাদর্শ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।
কেউ বলেন শিয়া আবার কেউ কেউ বলেন সুন্নি।যারা শিয়া বলেন।তারাও তার ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে একমত নন।
কারো মতে ইসমাইলি ।
আবার কারো মতে ইসনা আশারিয়া।
আবার কেউ বলেন ইখওয়ান আস-সাফা।
মাযহাব:
জাফরি তবে কেউ কেউ বলেন হানাফি।
*
তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত রচনাগুলি হল কিতাবুশ শিফা, একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ, এবং কানুন ফিত তিব, একটি চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ যা বহু মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রামাণিক মেডিকেল পাঠ্যবই হয়ে ওঠেএবং ১৬৫০ সাল পর্যন্ত এর ব্যবহার হতে থাকে।
দর্শন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও ইবনে সিনার রচনাসংকলনে জ্যোতির্বিজ্ঞান, আলকেমি, ভূগোল এবং ভূতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং কবিতা বিষয়ক লেখাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জন্ম ও প্রারম্ভিক:
ইবনে সিনা বুখারার (বর্তমান উজবেকিস্তান) অন্তর্গত খার্মাতায়েন জেলার আফসানা নামক স্থানে ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে (মতান্তরে, আগস্ট মাস) জন্মগ্রহণ করেন। আরবি পঞ্জিকা অনুসারে সালটি ছিল ৩৭০ হিজরি। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা। তাঁর মাতৃভাষা ছিল ফার্সি। ফার্সি ভাষায় তিনি বেশ কিছু কবিতা ও গ্রন্থ রচনা করেন। তবে সমকালীন অন্যান্যদের মতো তিনিও আরবি ভাষাকে জ্ঞান প্রকাশের মূল বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন। ইবন সিনার পিতা বুখারার সামানীয় সম্রাটের অধীনে একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।
শিক্ষা জীবন :
জন্মের পর ইবনে সিনা সপরিবারে আফসানাতে বাস করছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় ভাইয়ের জন্মের পর আবদুল্লাহ ও সিতারা সবাইকে নিয়ে বুখারায় চলে আসেন এবং তাদের শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। এখান থেকেই সিনার শিক্ষার সূচনা ঘটে। সব ভাইয়ের মধ্যে সিনা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে সমগ্র কুরআন মুখস্থ করেন। মুখস্থের পাশাপাশি তিনি সকল সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে চিন্তা করতেন। এতে তাঁর বাবা-মা ও শিক্ষক সকলেই বিস্মিত হতেন। তার পিতা তাকে ইসমাইলী শাস্ত্র বিষয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইবন সিনা ইসমাইলীদের কোনো কথাই বিনা যুক্তিতে মেনে নিতেন না। তাদের অনেক বিষয়ই তিনি যুক্তি দিয়ে প্রত্যাখান করেন। মূলত এরা সিনাকে শিক্ষা দেয়ার মত যোগ্য ছিল না। তাই আবদুল্লাহ পুত্রের জন্য যোগ্য শিক্ষকের খোঁজ করতে থাকেন।
আগে থেকেই তার পিতা সেখানকার এক মেওয়া বিক্রতার কথা জানতেন। এই বিক্রেতা ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিল। তার বাবা সিনাকে এই মেওয়া বিক্রতার কাছে গণিত শেখার ব্যবস্থা করে দেন। মেওয়া বিক্রেতা এর আগে কাউকে তার জ্ঞান বিতরণের সুযোগ পায় নি। এই সুযোগে সে সিনাকে সানন্দে শিক্ষা দিতে থাকে এবং সিনার মেধা এতে আরও সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় গণিতের অনেক বিষয় তাঁর আয়ত্তে এসে যায়। এরপর তাঁকে অধ্যয়ন করতে হয় ইসমাইলী শাস্ত্রের আইন অধ্যায়। এতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। এর মাঝে আর একজন যোগ্য শিক্ষকের সন্ধান পান সিনার পিতা। তিনি ছিলেন তৎকালীন অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব আল নাতেলী। নিজ পুত্রকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি নাতেলীকে নিজের গৃহে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এই শিক্ষকের কাছে সিনা ফিক্হ, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। ছাত্রের মেধা দেখে পড়ানোর সময় নাতেলী বিস্মিত হয়ে যেতেন; তার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভ্যাবাচেকা খেতে হত তাঁকে। বিস্মিত হয়ে তিনি আবদুল্লাহকে বলেছিলেন, "আপনার ছেলে একদিন দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবে। দেখবেন, ওর পড়াশোনায় কোন ব্যাঘাত যেন না ঘটে।
পরবর্তীতে সিনার শিক্ষক হিসেবে আরও দুজন নিযুক্ত হন: ইবরাহিম ও মাহমুদ মসসাহ।এসময় শিক্ষক নাতেলী বুঝতে পারেন সিনাকে বেশি দিন শিক্ষা দেয়ার মতো সামর্থ্য বা জ্ঞান তাঁর নেই। তখন ইবন সিনা শিক্ষার বিষয়ে অনেকটা নিজের উপর নির্ভর করেই চলতে থাকেন।
এসময় সম্পর্কে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
“
যে কোনো সমস্যার সমাধান ওস্তাদ যে রূপ করতেন, আমি তার চেয়ে ভালভাবে করতে পারতাম। তাঁর কাছে জাওয়াহির মানতিক বা তর্কশাস্ত্রের খনি নামক বইটি পড়ে মুখস্থ করার পর বুঝলাম, আমাকে শেখাবার মতো কিছু নতুন আর তাঁর কাছে নেই। তখন বইগুলো আর একবার পড়তে শুরু করলাম। ফলে সকল বিষয়ে আমি বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। ইউক্লিডের জ্যামিতির (দ্য এলিমেন্ট্স) প্রথম কয়েকটি সম্পাদ্যের সমাধানে ওস্তাদের সাহায্য নিয়ে বাকি কটির সমাধান আমি নিজেই করলাম। টলেমির ১৩ খণ্ডের আলমাজেস্ট বইটি শুরু করে সমস্যার সম্মুখীন হলে ওস্তাদ বললেন, "তুমি নিজে সমাধান করতে চেষ্টা কর, যা ফল দাঁড়ায় এনে আমাকে দেখাও। আমি বিচার করে রায় দেবো।" একে একে সব সমস্যার সমাধান করে ওস্তাদের সম্মুখে হাজির করলাম। তিনি দেখে-শুনে বললেন, "ঠিক হয়েছে, সব কটিই নির্ভুল সমাধান হয়েছে।" আমি বেশ বুঝতে পারলাম, এ ব্যাপারে ওস্তাদ আমার কাছ থেকে কিছু নতুন তথ্য শিখে নিলেন।
”
এভাবে নাতেলী বুঝতে পারলেন তাঁর প্রয়োজন শেষ। এরপর তিনি বুখারা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বুআলী নিজেই এবার নিজের শিক্ষক সাজলেন। এসময় চিকিৎসা শাস্ত্র এবং স্রষ্টাতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। অ্যারিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণ ধাতস্থ করেন এ সময়েই। নতুন বই না পেয়ে আগের বইগুলোই আবার পড়তে লাগলেন। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে পড়তে আসত। তরুণ বয়সেই তিনি এবার শিক্ষকতা শুরু করলেন।
কর্মজীবন:
এ সময় বুখারার বাদশাহ নুহ বিন মনসুর এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দেশ এবং বিদেশের সকল চিকিৎসকের চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। ততদিনে সিনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায়, বাদশাহের দরবারে তাঁর ডাক পড়ে। তিনি বাদশাহকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুললেন। তাঁর খ্যাতি এ সময় দেশেবিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরোগ্য লাভের পর বাদশাহ সিনাকে পুরস্কার দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। এসময় সিনা চাইলে বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদ লাভ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেবল বাদশাহ্র কাছে শাহি কুতুবখানায় (বাদশাহ্র দরবারের গ্রন্থাগার) প্রবেশ করে পড়াশোনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বাদশাহ তাঁর এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এভাবেই ইবন সিনা শাহি গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ পান। গ্রন্থাগারের ভিতরে গিয়ে অবাক হয়েছিলেন সিনা। কারণ এমন সব বইয়ের সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিলেন, যেগুলো এর আগেও কোনদিন দেখেন নি এবং এর পরেও কখনও দেখেন নি। প্রাচীন থেকে শুরু করে সকল লেখকদের বইয়ের অমূল্য ভাণ্ডার ছিল এই গ্রন্থাগার। সব লেখকের নাম তাদের রচনাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা তৈরির পর তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথা তাঁর মনেই থাকত না।
১০০১ সালে ইবন সিনার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। সুলতান নুহ বিন মনসুরও ততদিনে পরলোকে চলে গেছেন। নুহ বিন মনসুরের উত্তরাধিকারী নতুন সুলতান ইবন সিনাকে তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত করেন। এভাবে সিনা বুখারা অঞ্চলের শাসনকর্তার অধীনে সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নতুন। অভিজ্ঞতার অভাবে কার্য সম্পাদনে তাকে হিমশিম খেতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ট্রান্সঅক্সিনিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। খার্মাতায়েনের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ঐতিহাসিক আমু দরিয়া প্রবাহিত হয়ে গেছে যা বুখারা এবং তুর্কিস্তানের মধ্যবর্তী সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। ট্রান্সঅকসিনিয়া তথা খার্মাতায়েনের লোকেরা তাই বেশ দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিল। তাদের বিদ্রোহ দমন করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ইবন সিনা এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হন এবং এতে সুলতান তাঁর ওপর বেশ বিরক্ত হন। আত্মসম্মানবোধ থেকেই ইবন সিনা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। এই যাত্রায় তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কখনও রাজার হালে থেকেছেন, কখনও আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তবে সকল কিছুর মধ্যেও তাঁর মূল অবলম্বন ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের বলেই তিনি সবসময় সম্মানিত হয়েছেন। এর বদৌলতেই চরম দুর্দিনের মধ্যেও আনন্দের দেখা পেয়েছেন।
ভ্রমণ:
ইবনে সিনা অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিল সমৃদ্ধ। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী খোয়ারিজমে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পণ্ডিত আল বেরুনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। আল বেরুনির মূল উৎসাহ ছিল ভারতবর্ষ। কিন্তু ইবন সিনা কখনও ভারত অভিমুখে আসেননি। তিনি যাত্রা করেছিলেন পশ্চিম দিকে। তাঁর মূল উৎসাহও ছিল পশ্চিমের দিকে। এ কারণেই হয়তো তার চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতেও আপন অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। খোয়ারিজম থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এই শহরে তাঁর জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালেই চিকিৎসা বিষয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ আল কানুন ফিত্তিব রচনা করেন। এরপর যান পূর্ব পারস্যের অন্তর্গত খোরাসান শহরে। স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন সিনা। কিন্তু এসময় গজনীর সুলতান মাহমুদ ইবন সিনার গুণের কথা শুনতে পেরে তাঁকে তাঁর দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার নিকট দূত প্রেরণ করেন। নিজ দরবার নয়, সুলতান মাহমুদের ইচ্ছা ছিল তাঁর জামাতা খোয়ারিজম অধিপতির দরবারকে তিনি জ্ঞাণী-গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত করবেন। ইবন সিনাকে তিনি চেয়েছিলেন সভাসদ হিসেবে। কিন্তু সিনা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। সুলতান মাহমুদ এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন, ইবন সিনাকে হস্তান্তর করা হয়, যেভাবেই হোক; স্বেচ্ছায় আসতে না চাইলে বন্দি করে। কিন্তু ইবন সিনা এবার জর্জন থেকেও পালিয়ে গিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। এবার তাঁর যাত্রার দিক ছিল ইরান বরাবর।
শেষ জীবনও মৃত্যু:
ইরানে যাওয়ার পথে ইবন সিনা তাঁর সমসাময়িক কবি ফেরদৌসীর জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেছিলেন। এখান থেকে তিনি ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। ঐশ্বর্যশালী এবং ঐতিহাসিক এই নগরীটিকে ভালো লেগে গিয়েছিল ইবনে সিনার। এখানে অনেকদিন ছিলেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই তিনি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। হামাদানে তিনি এই প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীরস্থির মনে চিন্তা করার সময় সুযোগ লাভ করেন। হামাদানের সম্রাট তাঁর থাকাখাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি এখানে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন। এর সাথে তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ কিতাবুশ শিফা রচনা করেন। এই বইটি কবি উমর খৈয়ামের খুব প্রিয় ছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটি তাঁর সাথে ছিল বলে কথিত আছে। যাহোক, হামাদানে তিনি অনেক কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। সারাদিন পরিশ্রেমের পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন। সুবিশেষ দার্শনিক প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তার স্বভাবে ছিল না। তাই বলে কখনও আবার আমোদ-আহ্লাদে একেবারে মজে যেতেন না। নিজের ধীশক্তি সবসময় সক্রিয় রাখতে পারতেন। কখনোই বিস্মৃত হতেন না যে, তিনি একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞান চর্চাই তাঁর মুখ্য কাজ।
পরপারে যাত্রা:
হামাদানের সুলতান অসুস্থ হলে ইবন সিনা তাঁর চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট আরোগ্য লাভ করেন। এই চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি বরাবরের মতোই ছিলেন অপরিপক্ব। তাই এই পদপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশি ইবন সিনাকে সহ্য করতে পারছিল না। তাদের সাথে ইবন সিনার বিরোধের সৃষ্টি হয়। সেনাধ্যক্ষ সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকে। সৈন্য বাহিনীর প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সম্রাটের ছিল না। তাই তিনি ইবন সিনাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দি করে রাখেন। তা না হলে শত্রুদের হাতে হয়তো তিনি মারা পড়তেন। শত্রুর পাশাপাশি সিনার বন্ধুও ছিল অনেক। তাঁদের সহায়তায় সিনা এই কারাজীবন থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। হামাদান থেকে পালিয়ে তিনি ইরানের অন্যতম নগরী ইস্পাহানের পথে পা বাড়ান।
ইবন সিনার পলায়নের কিছুদিন পরই ইরানের ইস্পাহান নগরীতে এক ছদ্মবেশী সাধুর আবির্ভাব হয়েছিল। ইস্পাহানের সম্রাট জানতে পারেন যে এই সাধু আসলে ইবন সিনা। তিনি তাঁকে নিজ দরবারে নিয়ে আসেন এবং রাজসভায় আশ্রয় দান করেন। সিনাকে আশ্রয় দিতে পেরে সম্রাট নিজেও সম্মানিত বোধ করেছিলেন। ইস্পাহানে বেশ কিছুকাল তিনি শান্তিতে দিনাতিপাত করেন। হামাদানের কেউ তাকে এসময় বিরক্ত করত না। এখানে বসেই তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কিতাবুল ইশারাৎ রচনা করেন। কিন্তু এখানেও বেশি দিন শান্তিতে থাকতে পারেননি সিনা। অচিরেই হামাদান এবং ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ইস্পাহানের সম্রাট হামাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন। এ সময় সম্রাট ইবন সিনাকে সাথে নেয়ার ইচ্ছ প্রকাশ করেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের কারণেই তাঁকে নেয়ার ব্যাপারে সম্রাট মনস্থির করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেতে পারেন নি। ইস্পাহানের সৈন্যবাহিনীর নাথে হামাদানের পথে রওয়ানা করেন। হামাদানের সাথে সিনার অনেক স্মৃতি বিজড়িত ছিল। আর এখানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এই অসুখ আর সারে নি। হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে ইবন সিনা ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (৪২৮ হিজরী) মৃত্যুবরণ করেন।
দার্শনিক মতবাদ:
যুক্তিবিদ্যায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।
ইবনে সিনার ধর্মীয় মাযহাব নিয়ে একাধিক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক জহির আল দ্বীন আল বায়হাক্বি ইবনে সিনাকে ইখওয়ান আল সাফার অনুসারী বলে মনে করেন। অপরদিকে দিমিত্রি গুস্তা, আইশা খান এবং জুলস জে জেনসেন ইবনে সিনাকে সুন্নি হানাফি মাযহাবের অনুসারী হিসেবে দেখিয়েছেন। ইবনে সিনা হানাফি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ আলি ইবনে মানুনের আদালতে হানাফি বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইবনে সিনা জানিয়েছিলেন যে, অল্প বয়সে ইসমাইলিয়দের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হননি।যদিও, ইরানী দার্শনিক সৈয়দ হোসেন নসরের মতে ১৪শতকে শিয়া বিজ্ঞ নুরুল্লাহ শুশতারি অনুসারে ইবনে সিনা শিয়া অনুসারী ছিলেন।শারাফ খোরসানি এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে সুন্নি গভর্নর সুলতান মাহমুদ গজনবির একটি আমন্ত্রের প্রত্যাখ্যান পত্রকে নথি হিসেবে দেখিয়ে ইবনে সিনাকে ইসমাইলী অনুসারী বলেন। একই ধরেন দ্বিমত ইবনে সিনার পারিবারিক পটভূমির ভিত্তিতে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ লেখকেরা সুন্নি মতবাদী বলে মনে করলেও সাম্প্রতিককালে ইবনে সিনার পরিবারকে শিয়া অনুসারী বলে দাবী করা হয়।
এভাবে নাতেলী বুঝতে পারলেন তাঁর প্রয়োজন শেষ। এরপর তিনি বুখারা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বুআলী নিজেই এবার নিজের শিক্ষক সাজলেন। এসময় চিকিৎসা শাস্ত্র এবং স্রষ্টাতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। অ্যারিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণ ধাতস্থ করেন এ সময়েই। নতুন বই না পেয়ে আগের বইগুলোই আবার পড়তে লাগলেন। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে পড়তে আসত। তরুণ বয়সেই তিনি এবার শিক্ষকতা শুরু করলেন।
কর্মজীবন:
এ সময় বুখারার বাদশাহ নুহ বিন মনসুর এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দেশ এবং বিদেশের সকল চিকিৎসকের চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। ততদিনে সিনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায়, বাদশাহের দরবারে তাঁর ডাক পড়ে। তিনি বাদশাহকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুললেন। তাঁর খ্যাতি এ সময় দেশেবিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরোগ্য লাভের পর বাদশাহ সিনাকে পুরস্কার দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। এসময় সিনা চাইলে বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদ লাভ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেবল বাদশাহ্র কাছে শাহি কুতুবখানায় (বাদশাহ্র দরবারের গ্রন্থাগার) প্রবেশ করে পড়াশোনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বাদশাহ তাঁর এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এভাবেই ইবন সিনা শাহি গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ পান। গ্রন্থাগারের ভিতরে গিয়ে অবাক হয়েছিলেন সিনা। কারণ এমন সব বইয়ের সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিলেন, যেগুলো এর আগেও কোনদিন দেখেন নি এবং এর পরেও কখনও দেখেন নি। প্রাচীন থেকে শুরু করে সকল লেখকদের বইয়ের অমূল্য ভাণ্ডার ছিল এই গ্রন্থাগার। সব লেখকের নাম তাদের রচনাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা তৈরির পর তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথা তাঁর মনেই থাকত না।
১০০১ সালে ইবন সিনার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। সুলতান নুহ বিন মনসুরও ততদিনে পরলোকে চলে গেছেন। নুহ বিন মনসুরের উত্তরাধিকারী নতুন সুলতান ইবন সিনাকে তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত করেন। এভাবে সিনা বুখারা অঞ্চলের শাসনকর্তার অধীনে সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নতুন। অভিজ্ঞতার অভাবে কার্য সম্পাদনে তাকে হিমশিম খেতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ট্রান্সঅক্সিনিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। খার্মাতায়েনের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ঐতিহাসিক আমু দরিয়া প্রবাহিত হয়ে গেছে যা বুখারা এবং তুর্কিস্তানের মধ্যবর্তী সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। ট্রান্সঅকসিনিয়া তথা খার্মাতায়েনের লোকেরা তাই বেশ দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিল। তাদের বিদ্রোহ দমন করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ইবন সিনা এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হন এবং এতে সুলতান তাঁর ওপর বেশ বিরক্ত হন। আত্মসম্মানবোধ থেকেই ইবন সিনা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। এই যাত্রায় তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কখনও রাজার হালে থেকেছেন, কখনও আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তবে সকল কিছুর মধ্যেও তাঁর মূল অবলম্বন ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের বলেই তিনি সবসময় সম্মানিত হয়েছেন। এর বদৌলতেই চরম দুর্দিনের মধ্যেও আনন্দের দেখা পেয়েছেন।
ভ্রমণ:
ইবনে সিনা অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিল সমৃদ্ধ। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী খোয়ারিজমে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পণ্ডিত আল বেরুনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। আল বেরুনির মূল উৎসাহ ছিল ভারতবর্ষ। কিন্তু ইবন সিনা কখনও ভারত অভিমুখে আসেননি। তিনি যাত্রা করেছিলেন পশ্চিম দিকে। তাঁর মূল উৎসাহও ছিল পশ্চিমের দিকে। এ কারণেই হয়তো তার চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতেও আপন অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। খোয়ারিজম থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এই শহরে তাঁর জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালেই চিকিৎসা বিষয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ আল কানুন ফিত্তিব রচনা করেন। এরপর যান পূর্ব পারস্যের অন্তর্গত খোরাসান শহরে। স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন সিনা। কিন্তু এসময় গজনীর সুলতান মাহমুদ ইবন সিনার গুণের কথা শুনতে পেরে তাঁকে তাঁর দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার নিকট দূত প্রেরণ করেন। নিজ দরবার নয়, সুলতান মাহমুদের ইচ্ছা ছিল তাঁর জামাতা খোয়ারিজম অধিপতির দরবারকে তিনি জ্ঞাণী-গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত করবেন। ইবন সিনাকে তিনি চেয়েছিলেন সভাসদ হিসেবে। কিন্তু সিনা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। সুলতান মাহমুদ এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন, ইবন সিনাকে হস্তান্তর করা হয়, যেভাবেই হোক; স্বেচ্ছায় আসতে না চাইলে বন্দি করে। কিন্তু ইবন সিনা এবার জর্জন থেকেও পালিয়ে গিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। এবার তাঁর যাত্রার দিক ছিল ইরান বরাবর।
শেষ জীবনও মৃত্যু:
ইরানে যাওয়ার পথে ইবন সিনা তাঁর সমসাময়িক কবি ফেরদৌসীর জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেছিলেন। এখান থেকে তিনি ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। ঐশ্বর্যশালী এবং ঐতিহাসিক এই নগরীটিকে ভালো লেগে গিয়েছিল ইবনে সিনার। এখানে অনেকদিন ছিলেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই তিনি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। হামাদানে তিনি এই প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীরস্থির মনে চিন্তা করার সময় সুযোগ লাভ করেন। হামাদানের সম্রাট তাঁর থাকাখাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি এখানে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন। এর সাথে তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ কিতাবুশ শিফা রচনা করেন। এই বইটি কবি উমর খৈয়ামের খুব প্রিয় ছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটি তাঁর সাথে ছিল বলে কথিত আছে। যাহোক, হামাদানে তিনি অনেক কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। সারাদিন পরিশ্রেমের পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন। সুবিশেষ দার্শনিক প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তার স্বভাবে ছিল না। তাই বলে কখনও আবার আমোদ-আহ্লাদে একেবারে মজে যেতেন না। নিজের ধীশক্তি সবসময় সক্রিয় রাখতে পারতেন। কখনোই বিস্মৃত হতেন না যে, তিনি একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞান চর্চাই তাঁর মুখ্য কাজ।
পরপারে যাত্রা:
হামাদানের সুলতান অসুস্থ হলে ইবন সিনা তাঁর চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট আরোগ্য লাভ করেন। এই চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি বরাবরের মতোই ছিলেন অপরিপক্ব। তাই এই পদপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশি ইবন সিনাকে সহ্য করতে পারছিল না। তাদের সাথে ইবন সিনার বিরোধের সৃষ্টি হয়। সেনাধ্যক্ষ সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকে। সৈন্য বাহিনীর প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সম্রাটের ছিল না। তাই তিনি ইবন সিনাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দি করে রাখেন। তা না হলে শত্রুদের হাতে হয়তো তিনি মারা পড়তেন। শত্রুর পাশাপাশি সিনার বন্ধুও ছিল অনেক। তাঁদের সহায়তায় সিনা এই কারাজীবন থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। হামাদান থেকে পালিয়ে তিনি ইরানের অন্যতম নগরী ইস্পাহানের পথে পা বাড়ান।
ইবন সিনার পলায়নের কিছুদিন পরই ইরানের ইস্পাহান নগরীতে এক ছদ্মবেশী সাধুর আবির্ভাব হয়েছিল। ইস্পাহানের সম্রাট জানতে পারেন যে এই সাধু আসলে ইবন সিনা। তিনি তাঁকে নিজ দরবারে নিয়ে আসেন এবং রাজসভায় আশ্রয় দান করেন। সিনাকে আশ্রয় দিতে পেরে সম্রাট নিজেও সম্মানিত বোধ করেছিলেন। ইস্পাহানে বেশ কিছুকাল তিনি শান্তিতে দিনাতিপাত করেন। হামাদানের কেউ তাকে এসময় বিরক্ত করত না। এখানে বসেই তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কিতাবুল ইশারাৎ রচনা করেন। কিন্তু এখানেও বেশি দিন শান্তিতে থাকতে পারেননি সিনা। অচিরেই হামাদান এবং ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ইস্পাহানের সম্রাট হামাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন। এ সময় সম্রাট ইবন সিনাকে সাথে নেয়ার ইচ্ছ প্রকাশ করেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের কারণেই তাঁকে নেয়ার ব্যাপারে সম্রাট মনস্থির করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেতে পারেন নি। ইস্পাহানের সৈন্যবাহিনীর নাথে হামাদানের পথে রওয়ানা করেন। হামাদানের সাথে সিনার অনেক স্মৃতি বিজড়িত ছিল। আর এখানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এই অসুখ আর সারে নি। হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে ইবন সিনা ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (৪২৮ হিজরী) মৃত্যুবরণ করেন।
দার্শনিক মতবাদ:
যুক্তিবিদ্যায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।
ইবনে সিনার ধর্মীয় মাযহাব নিয়ে একাধিক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক জহির আল দ্বীন আল বায়হাক্বি ইবনে সিনাকে ইখওয়ান আল সাফার অনুসারী বলে মনে করেন। অপরদিকে দিমিত্রি গুস্তা, আইশা খান এবং জুলস জে জেনসেন ইবনে সিনাকে সুন্নি হানাফি মাযহাবের অনুসারী হিসেবে দেখিয়েছেন। ইবনে সিনা হানাফি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ আলি ইবনে মানুনের আদালতে হানাফি বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইবনে সিনা জানিয়েছিলেন যে, অল্প বয়সে ইসমাইলিয়দের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হননি।যদিও, ইরানী দার্শনিক সৈয়দ হোসেন নসরের মতে ১৪শতকে শিয়া বিজ্ঞ নুরুল্লাহ শুশতারি অনুসারে ইবনে সিনা শিয়া অনুসারী ছিলেন।শারাফ খোরসানি এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে সুন্নি গভর্নর সুলতান মাহমুদ গজনবির একটি আমন্ত্রের প্রত্যাখ্যান পত্রকে নথি হিসেবে দেখিয়ে ইবনে সিনাকে ইসমাইলী অনুসারী বলেন। একই ধরেন দ্বিমত ইবনে সিনার পারিবারিক পটভূমির ভিত্তিতে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ লেখকেরা সুন্নি মতবাদী বলে মনে করলেও সাম্প্রতিককালে ইবনে সিনার পরিবারকে শিয়া অনুসারী বলে দাবী করা হয়।