বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

রোবটিকসের জনক ইসমাঈল আল-জাজারি


জকে আমরা পরিচিত হব একজন মহান বিজ্ঞানীর সঙ্গে। যাঁকে রোবটিকসের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়া তিনি একাধারে একজন পণ্ডিত, আবিষ্কারক, যন্ত্রপ্রকৌশলী, কারিগর, শিল্পী ও গণিতবিদ ছিলেন।


বাদিউজ জামান আবুল ঈজ ইবনে ইসমাঈল আল-জাজারি। তিনি ১১৩৬ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের দাজলা (টাইগ্রিস) নদীর তীরবর্তী ‘জাজিরা ইবনে উমার’ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্কলার, উদ্ভাবক ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ছিলেন মুসলিম সভ্যতার একজন মহান বিজ্ঞানী।

১১৭৪ সাল থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞান সাধনায় লেগে থাকেন তিনি। বিজ্ঞানে প্রথম রোবটিক যন্ত্রের আবিষ্কার করেন এই মহান বিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণাকর্মে সহযোগিতা করেন আদির অঞ্চলের শাসক নাসির উদ্দীন মাহমুদ (তিনি সালাহউদ্দীন আইয়ুবির বংশধর ছিলেন)। তাঁরই অনুরোধে ইসমাঈল আল-জাজারি তাঁর গবেষণাগুলো পুস্তিকা আকারে সংরক্ষণ করেন। যার নাম দেওয়া হয়, ‘কিতাবুল হিয়াল’। যেহেতু তিনি একজন সুদক্ষ চিত্রশিল্পীও ছিলেন, তাই তাঁর উদ্ভাবনের থিওরিগুলো আরব্য চিত্রশিল্পের ধাঁচে এমনভাবে চিত্রাকারে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা পাঠককে তাঁর থিওরিগুলো সহজে বুঝতে ও পুনর্গঠন করতে সাহায্য করেছিল।

(ওয়ান থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান ইনভ্যানসন্স মুসলিম হ্যারিটেজ ইন আওয়ার ওয়ার্ল্ড, পৃ. ১৫)গ্রন্থটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটির কয়েকটি মূল কপি বিশ্বের বিখ্যাত কিছু জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। যার মধ্যে ফ্রান্সের বিখ্যাত ‘ল্যুভ মিউজিয়াম’ ও যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ‘আর্টস মিউজিয়াম’ অন্যতম।

মিউজিয়ামগুলোতে আসা দর্শনার্থীরা খুব যত্নের সঙ্গেই গ্রন্থটি দেখেন। তাঁর মৃত্যুর ১০০ বছর পর ইউরোপের বিজ্ঞানীরা সেসব ধারণা নিয়ে বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড আর হিল তাঁর রচিত ‘স্টাডিজ ইন মেডিয়েভল ইসলামিক টেকনোলজি’ পুস্তকে উল্লেখ করেন : ‘প্রকৌশলের ইতিহাসে আল-জাজারির গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আধুনিককাল পর্যন্ত আর কোনো সভ্যতা থেকে এর তুলনীয় যন্ত্রের নকশা, উৎপাদন ও বিভিন্ন নির্দেশসংবলিত তেমন কোনো রচনা পাওয়া যায়নি। এর প্রভাব পরবর্তীকালের স্টিম-ইঞ্জিন এবং অন্তর্দাহ যন্ত্রের (internal combustion) নকশায় দেখা যায়।’

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় ইংরেজ প্রাচ্যবিদ এবং বিজ্ঞানী ডোনাল্ড হিল (১৯২২-১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটি অনুবাদ করে জাদুঘরের আড়াল থেকে জ্ঞানপিপাসুদের দৃষ্টির সামনে নিয়ে আসেন। যার নাম দেওয়া হয়, ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইঞ্জিনিয়ার্স মেকানিক্যাল ডিভাইসেজ’।

মার্কিন ইতিহাসবিদ ও ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর লেইন হোয়াইট জুনিয়র (১৯০৭-১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ) ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইঞ্জিনিয়ার্স মেকানিক্যাল ডিভাইসেজ’-এর ভূমিকায় লেখেন, অধুনা ইউরোপে আবিষ্কৃত অনেক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মূল ধারণা ও নকশা আল-জাজারির গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

আল-জাজারি শুধু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ধারণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। বরং তাঁর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে কিছু মূল্যবান যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্বয়ংক্রিয় ফ্লাশ মেকানিজমসমৃদ্ধ একটি ওয়াশিং মেশিন। যার মাধ্যমে বাদশাহ নাসির উদ্দীন মাহমুদ অজু করতেন। আজকের বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম রোবটিক যন্ত্র! এখান থেকেই অন্যান্য রোবটিক যন্ত্রের ধারণা তৈরি হয়। (প্রাগুক্ত)এ ছাড়া তাঁর আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে এলিফেন্ট ক্লক বা হাতিঘড়ি, যার একটি নমুনা বর্তমানে দুবাইয়ের ইবনে বতুতা শপিং মলে সাজানো আছে। রয়েছে আল-জাজারির ১১ ফুট উঁচু জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক দুর্গ-ঘড়িটিতে সময় গণনা ছাড়াও রাশিচক্র এবং সৌর ও চন্দ্র কক্ষপথ দেখানো হয়েছে।

আল-জাজারি পানির শক্তির সাহায্যে ময়ূর-রোবট এবং পানির শক্তিতে চালিত ঘড়ির অংশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয় দরজাও নির্মাণ করেন। তিনি একটি মানবাকৃতির রোবট পরিচারিকা তৈরি করেন, যা পানীয় পরিবেশন করতে পারত। ফ্লাশ প্রযুক্তিসহ আল-জাজারি একটি স্বয়ংক্রিয় বেসিন উদ্ভাবন করেন, যা আজকাল আধুনিক ফ্লাশ টয়লেটে ব্যবহৃত হয়। এতে একটি নারী-রোবট পানিভর্তি বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যবহারকারী একটি লিভার টান দিলেই পানি নিচে চলে যায় এবং নারী-রোবটটি আবার বেসিনে পানি ভরে দেয়।

রাজকীয় আসরের অতিথিদের চিত্তবিনোদনের জন্য আল-জাজারি নির্মিত চারটি সংগীতজ্ঞ রোবটসহ একটি নৌকা একটি কৃত্রিম হ্রদে ভাসমান থাকবে। এর প্রোগ্রামেবল ঢোলকের কাঠিগুলো ঘোরালে ঢোলবাদক বিভিন্ন ছন্দে ও তালে ঢোল বাজাতে পারবে। এমন আরো অনেক উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি পৃথিবীকে চিরঋণী করেছিলেন।
Previous Post
Next Post
Related Posts