বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০২২

মুয়াল্লিম আল-ফারাবি | Abu Nasr Al-Farabi | Alpharabius


পৃথিবীতে মুসলমানদের উন্নতির জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আশীর্বাদ হিসেবে যুগে যুগে যে সকল মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিককে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন আল ফারাবি তাদের অন্যতম।

জন্ম:
তার পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও রাজনৈতিক কারণে তার পূর্ব পুরুষগণ পারস্য ত্যাগ করে তুর্কিস্থানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

আবু নসর আল ফারাবী আনুমানিক  ৮৭২, মতান্তরে ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিস্তানের অন্তর্গত 'ফারাব' নামক শহরের নিকটবর্তী 'আল ওয়াসিজ' নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

নাম:
মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল ফারাবির আসল নাম আবুনাসের মোহাম্মদ ইবনে ফারাখ আলফারাবি।
আল ফারাবির পিতা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত এবং সেনাবাহিনীর একজন উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা।

জ্ঞানার্জন:
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা নিজ এলাকা ফারাবেই সম্পন্ন করেন।অত:পর তিনি বুখারারার কাজি নিযুক্ত হন।

ঘটনা বৈচিত্র্য তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ।জ্ঞান সাধনার অদম্য বাসনা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্যে তিনিবাগদাদ গমন করেন।  তিনি সেখানে প্রায় ৪০ বছর ধরে অধ্যায়ন ও গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। জ্ঞানের অন্বেষণে তিনি ছুটে গিয়েছেন দামেস্কে, মিসরে এবং দেশ-বিদেশের আরও বহুস্থানে।

কয়েকটি ভাষার উপর তিনি পূর্ণ দখল অর্জন করেন।মুসলিম সমাজের একেবারে প্রথম দিককার মনিষীদের মধ্যে আল ফারাবি একজন, যিনি জ্ঞানার্জনের জন্য খ্রিস্টান মিশনারি কিংবা ভারতবর্ষের আর্য বা হিন্দুদের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন।

বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবন:
তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়  পারদর্শী ছিলেন। তবে দার্শনিক বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছাড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ছুটি গিয়েছেন দামেস্কে, দেশ-বিদেশের আরো অনেক স্থানে পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতিতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। মূলত দর্শন ও বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সর্বাধিক। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনি শূন্যতার অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। তিনি বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক হিসেবে আরোহন করেছিলেন জ্ঞানের শীর্ষে।তিনি সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে বহু রচনা লিখেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শতাধিক।তবে এ সকল অমূল্য অধিকাংশ গ্রন্থের সন্ধান মেলেনি। পদার্থবিজ্ঞানে তিনি শূন্যতার অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন ।

বিভিন্ন শাস্ত্রে অবদান:

দর্শন:
প্লেটো ও এরিস্টটলএর দর্শনের উপর তিনি বিস্তর আলোচনা করেছেন। প্লেটোর রিপাবলিক-এর মত তিনিও একটি আদর্শ রাষ্ট্র-এর কল্পনা করেছেন তার আদর্শ নগর গ্রন্থে।

মধ্যযুগের দার্শনিকগণ, কী মুসলিম কী খ্রিস্টান, সকলেই নিজের ধর্ম দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সহজ করে বলতে গেলে তাদের নিকট দর্শন মানেই ছিল ধর্মীয় দর্শন।কিন্তু আল ফারাবি এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসেন।

তিনি স্রষ্টার সর্বাধিপত্য স্বীকারের পাশাপাশি সৃষ্টিকেও শাশ্বত বলে মনে করতেন। তিনি কোন চরম মত পোষণ করতেন না এবং চিন্তার ক্ষেত্রে পরস্পর-বিরোধী মতকে প্রায়শই একসাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন।  তিনি ধর্ম আর দর্শনের মাঝে তফাৎ স্পষ্ট করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধিতে উৎকর্ষ সাধনের জন্যই। 

রাষ্ট্র দর্শন:
তার সময়ে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে রাজনীতি অনীহার যে রোগ ছিল তা থেকেও মুক্ত ছিলেন আল ফারাবি। তিনি বেশ রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও কাজ করেছেন।

আদর্শ নগর-এ তার রাষ্ট্রনায়ক-এর একনায়ক বৈশিষ্ট্য প্রকট। তার মতে রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রের সর্বৈব ক্ষমতা পোষণ করবেন এবং অন্য সবাই তার বাধ্য থাকবেন। নাগরিকদের ক্ষমতায়ও থাকবে শ্রেণী বিভাজন, যেখানে কোনো শ্রেণী তার উপরের শ্রেণীর আদেশ মান্য করবে ও নিচের শ্রেণীর উপর আদেশ জারী করবে। তৎকালীন বহুধাবিভক্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় আনতে এই রাষ্ট্র দর্শন প্রভাব বিস্তার করে এবং সময়ের বিচারে এরূপ ভাবধারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আদর্শ রাষ্ট্রের নেতার ক্ষেত্রে প্লেটো যেমন ‘ফিলসফার কিং’ এর কথা বলেছিলেন, ফারাবি এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম বা ধর্মীয় নেতার কথা বলেছেন। তার মতে একজন ইমামই সকল ভালো-মন্দের পার্থক্য সঠিকরূপে বুঝতে পারেন এবং রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর সময়ের মদিনা শহরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্য নগরের উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

আদর্শ রাষ্ট্রকে তিনি অসম্ভব উল্লেখ করলেও এটি অর্জনের জন্য মানুষের চিরন্তন প্রচেষ্টাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন। মুসলিম মিল্লাতে তার অবদান অনস্বীকার্য।


যুক্তিশাস্ত্র:

যুক্তিশাস্ত্রে আল ফারাবি অ্যারিস্টটলীয় পন্থা অবলম্বন করলেও তিনি অ্যারিস্টটলের বাইরে গিয়েও অনেক কিছু আলোচনা করেছেন। তিনি ‘কন্ডিশনাল সিলোজিজম’ বা শর্তাধীন অনুমান এবং ‘অ্যানালজিক্যাল ইন্টারফিয়ারেন্স’ বা সাদৃশ্যমূলক হস্তক্ষেপ (যুক্তিশাস্ত্রের কিছু পদ্ধতি) নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। তিনি অ্যারিস্টটলের কাজের উপর বেশ কিছু টীকাও লেখেন। আল-ফারাবীর মতে, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনে তেমন কোন পার্থক্য নেই। বরং দর্শন হল উচ্চতর যুক্তিবিদ্যা।

রচনাবলী:
আল ফারাবি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব,রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, চিকিৎসা, যুক্তিশাস্ত্র,পদার্থ বিজ্ঞান,সমাজ বিজ্ঞান,সঙ্গীত,গণিত,
ফালসাফা প্রভৃতি বিষয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন।তবে বিজ্ঞান ও দর্শনে তার অবদান ছিল সর্বাধিক। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনিই “শূন্যতার” অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। দার্শনিক হিসেবে ছিলেন নিউ প্লেটনিষ্টদের পর্যায়ে বিবেচিত।

তিনি সর্বপ্রথম ইসলামী তর্কশাস্ত্র ও ইসলামী বিশ্বকোষ রচনা করেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থে পীথাগোরাস, হিরোক্লিটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, থিও ফ্রিসটাস, অ্যারিস্টিপাস, ডাইওজেনিস, ইপিকিউরিয়ান, স্টোয়িক প্রমুখ দার্শনিকের উদ্ধতি ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আল-ফারাবী একজন সত্যের সন্ধানী দার্শনিক ছিলেন। তিনি অতি সাবধানে তাঁর দর্শনগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর দর্শনে ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদের প্রকাশ নেই।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে:
১: আল মদীনাতুল ফাজীলা
২: আল মদীনাতুল মাদানিয়া
৩: জাওয়ামিনুস সিয়াসাত
৪: ইজতিমাউ মাদানিয়া
৫: খাওয়ামি নেয়ামত
৬: কিতাব আল মুসিকি আল কবির (দ্য গ্রেট বুক অব মিউজিক)
৭: কিতাব ইহসা আল উলুম (দ্য ইন্ট্রোডাকশন টু নলেজ)
৮: কিতাব ইহসা আল ইকাআত (ক্লাসিফিকেশন অব রিদমস)

আল ফারাবি একজন উর্বর লেখক ছিলেন, যার লেখার প্রধান দিক ছিল নিওপ্লেটোনিজম এবং লেখার স্টাইল ছিল অ্যারিস্টটলীয়। তার একটি ভালো দিক ছিল এই যে তিনি নিজ দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অসংখ্য দার্শনিক এবং তাদের দর্শনের কথা আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে তার লেখা রাজনৈতিক ট্রিটিগুলো মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদি দার্শনিক ম্যামোনাইডসকেও প্রভাবিত করেছিল। তিনি আল ফারাবিকে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম যুক্তিবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এজন্য তাকে মুয়াল্লিম আছ-ছানী বলা হয়।

মৃত্যু:
আল ফারাবি শেষ জীবনে সিরিয়ার আলেপ্পোতে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

তথ্যসূত্রঃ
1. আল ফারাবি ইসলামী দর্শনে এক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক, রোদ্দুরে ডটকম।
2. দর্শনকোষ সরদার ফজলুল করিম।
3. বিশিষ্ট দার্শনিক আল ফারাবি
4. উইকিপিডিয়া

লিখেছেন— Raqib Hussain

Previous Post
Next Post
Related Posts