দু'শো (২০০) বছর রক্ত চুষে যুলুম করে খাওয়া, বেনিয়া ইংরেজদের থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় ব্রিটিশ, অবিভক্ত ভারতের ৫০০ টি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ভারতের সাথে যোগ দেয়। পাকিস্তানের সাথে যায় কিছু।
জুনাগড়, কাশ্মীর, হায়দারাবাদ স্বাধীন থাকতে চায়। কৌশলে, ধোঁকা দিয়ে এবং অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে কাশ্মীর আর জুনাগড়কে থামানো গেলেও; কয়েকশো বছরের স্বাধীন হায়দারাবাদ ভারতের পরাধীনতা মনে নেয়নি।
হায়দারাবাদ প্রধানকে বলা হতো "নিজাম-উল-মুলক"। হায়দারাবাদেরর ছিলো কয়েকশো বছরের স্বাধীনতার সমৃদ্ধ ইতিহাস। তাদের নিজস্ব মুদ্রা ছিল, পৃথক সংস্কৃতি ছিল।
হায়দারাবাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল আলাদা।
২ লাখ ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের হায়দারাবাদ, জনসংখ্যায় ছিল দেড় (১.৫) কোটির মতো।
কিছুকাল মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত থাকলেও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তদানীং নিজাম কামরুদ্দীন আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে হায়দারাবাদের নিজাম, ইংরেজদের আনুগত্য গ্রহণ করে নেয়। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হায়দারাবাদের "সপ্তম নিজাম উসমান আলী" ভারতের সাথে হায়দারাবাদের-ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
অনেক চেষ্টা-তদবিরের পরেও যখন হায়দারাবাদ, ভারতের বশ্যতা স্বীকার করল না তখন ভারত প্রধানমন্ত্রী "জওহরলাল নেহেরু" ঘোষণা করলেন—
"(হায়দারাবাদ স্বাধীন হলো ঠিক, তবে আমরা যখন প্রয়োজন মনে করব, হায়দারাবাদের বিরুদ্ধে সেনা-অভিযান পরিচালনা করব)"
এক পর্যায়ে হায়দারাবাদ দখলের ব্যাপারে ভারত বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার অংশ হিসেবে হায়দারাবাদে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের সক্রিয় করা হয়। হায়দারাবাদ এর রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়।
সংবাদ সংস্থা ‘ বি বি সি’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী—
“Historians say their desire to prevent an independent Muslim-led state taking root in the heart of predominantly Hindu India was another worry.”
অর্থাৎ "ইতিহাসবিদগণের মতে, হিন্দু প্রধান ভারতের মাঝে একটি স্বাধীন মুসলিম পরিচালিত প্রদেশ; তাদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল"।
শিক্ষাঙ্গন, সাংস্কৃতিক জগৎ, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভারত সরকারের অনুগত লোক তৈরি করা হয়। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অনুগত দালাল সৃষ্টি করা হয়। এমনকি হায়দারাবদের সেনাপ্রধান "আলি আহমদ সৈয়দ আল ইদরিস" নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের অনুগত বানানো হয়।
হিন্দু মৌলবাদীদের দিয়ে নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উস্কে দেয়া হয়। কংগ্রেসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও আর্য সমাজ এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
হায়দারাবাদের বিখ্যাত চার মিনার মসজিদ,
বাহির থেকে নানামুখি ষড়যন্ত্র করে হায়দারাবাদের অভ্যন্তরীর পরিস্থিতি যখন আক্রমণের উপযোগী করে তোলা হয়; এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী "সরদার প্যাটেল" হায়দারাবাদকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেন।
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে
রাজধানী তেলেঙ্গুনায় কম্যুনিস্ট বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে "অপারেশন পোলো" নামে হায়দারাবাদে সামরিক অভিযান ঘোষণা করা হয়।
ভারতের বিখ্যাত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল "জয়ন্ত নাথ চৌধুরীর" নেতৃত্বে ৫ ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য এবং একটি আর্মার্ড স্কোয়াড্রন (ট্যাংক) নিয়ে হায়দারাবাদ আক্রমণ শুরু হয়।
সেনা-প্রধান "সৈয়দ আলি আহমদ আল ইদরিস" থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদাধীকারী অনেকেই যেহেতু আগে থেকেই ভারত সরকারের সাথে যুদ্ধ শরীক না হওয়ার চুক্তিবদ্ধ ছিল; তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তেমন বাঁধার মুখোমুখি হতে হয়নি।
সেনা-প্রধানরআল ইদরিস, হায়দারাবাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অরক্ষিত রেখেছিল। সেনাবাহিনীকে গড়ে রেখেছিল অপ্রস্তুত অবস্থায়। সেনাপ্রধানের সহায়তায় ভারত সরকার হায়দারাবাদে তার বিপুল সেনাশক্তি, পদাতিক বাহিনী ও বিমানবাহিনী সহকারে শুরু করলো সামরিকভাবে আক্রমণ। প্রথমে ট্যাংক বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। এরপর বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে বিভিন্ন বিমানবন্দর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আর্য সমাজ ও অন্যান্য হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলো হায়দারাবাদে প্রায় দুই (২) লাখ মুসলিমদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।
মাদরাসা, মসজিদসহ মুসলমানদের অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়। পাঁচ (৫) দিন ধরে চলা যুদ্ধে হায়দারাবাদ সেনাবাহিনী পরাজিত হয়।
১৮ সেপ্টেম্বর "নিজাম উসমান আলী খান" রেডিওতে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন।
দখলদার ভারত ২ লাখ মানুষের গণহত্যার বিনিময়ে, আরও একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড নিজের দখলে করে নেয়।
এবং "(কর্নাটক, অন্ধ ও মহারাষ্ট্র)" এই তিনটি (৩) প্রদেশে হায়দারাবাদকে বিভক্ত করে দেয়।
সুন্দরলাল কমিটির মতে, খুব কম করে ধরলেও ২৭০০০ থেকে ৪০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। যদিও "এ জি নুরানি" ও অন্যান্য গবেষকদের মতে, এ-সংখ্যা দুই (২) লাখ বা তার থেকেও বেশী।
কমিটির রিপোর্টের কিছু তথ্যতে দেখা যায়—
“বেশ কয়েক জায়গায়, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা শহর ও গ্রাম থেকে মুসলিম পুরুষদের ধরে নিয়ে এনে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে।”
“অনেক জায়গায় আমাদের দেখানো হয় কুয়া; যেগুলো ছিল পচা লাশে ভরা। এ-রকম একক্ষেত্রে আমরা ১১ টি লাশ দেখেছি, যার মধ্যে ছিল একজন মহিলা যার ছোট শিশুটি তার স্তনের সাথে লেগেছিল।”
“দেখেছি ডোবা-নালার মধ্যে লাশ ছড়িয়ে আছে। বেশ কয়েক জায়গায় দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল ; আমরা গিয়ে দেখেছি পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া হাড় আর খুলি এখনও সেখানে পড়ে আছে।”
“হাজার হাজার পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছিল,
শিশুরা তাদের পিতামাতার কাছ থেকে আর স্ত্রীরা তাদের স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। মহিলা ও তরুণীদের ধাওয়া করা হত আর ধর্ষণ করা হত”।
সুন্দরলাল কমিটির রিপোর্টের লিঙ্ক— https://www.scribd.com/doc/239943850/Pandit-Sundarlal-Committee-Report-on-the-Massacres-in-Hyderabad-1948
স্বাধীন হায়দারাবাদ; ২ লাখ মানুষের গণহত্যা ও ধর্ষনের ঐ ঘটনার ব্যাপারে ভারত সরকার কখনোই কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে খুব অল্পসংখ্যক ভারতীয়ই ওই গণহত্যার কথা জানে।
সমালোচকরা দাবি করেন, ভারতের প্রতিটি সরকারই ওই ঘটনার তথ্য গোপন করে রেখেছে।
নোট— ছবিতে হায়দারাবাদের পতনের পর 'বল্লভ ভাই প্যাটেল ও হায়দারাবাদের 'নিজাম।
মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার ও নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। জিহাদের রাস্তা সমুন্নত করে দিক ও আমাদের মনকে প্রস্তরখন্ড তৈরি করে দিক।
তথ্যঋণ— সত্যের সন্ধানে।
স্বাধীন হায়দারাবাদ দখলের ইতিহাস
জুলাই ০৮, ২০২২
Tags:
বিভিন্ন যোদ্ধ