রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০২২

বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল : Bodorer juddho : Bodor war

২য় হিজরীর ১৭ রামাদান সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ।

সত্য আর মিথ্যার মাঝে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার দিন। আল ইয়াওমাল ফুরক্বান!

আল্লাহুম্মানসুরনা ‘আলাল ক্বাওমিল কাফিরীন!

1. হক্কের পক্ষে মাত্র ৩১৩জন vs বাতিলের পক্ষে ১০০০।
2. বদর প্রান্তরে মালাইকাদের অবতরণ ।
3. সাহাবাদের চোখে কাফিরদের সংখ্যা কম করে দেখানো।
4. শাইত্বনদের আতংকিতবস্থায় পলায়ন।
5. মুসলিমদের/ইসলামের একতরফা বিজয়।
6. সংখ্যা কখনো হক্ব প্রতিষ্ঠার মানদন্ড নয়।

বদর যুদ্ধের কারণসমূহ:

মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা; আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ষড়যন্ত্র, মদিনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, আর্থিক কারণ, নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, আবু সুফিয়ানের কাফেলা আক্রমণের মিথ্যা গুজব।

দ্বিতীয় হিজরী সালে নাবী (ﷺ) এর কাছে এই মর্মে খবর পৌঁছল যে, কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া হতে মক্কার পথে অগ্রসর হচ্ছে। কাফেলার নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। নাবী (ﷺ) কাফেলাটির পিছু ধাওয়া করার আহবান জানালেন। তবে এর জন্য বেশী প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন নি। দ্রুত বের হওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে এর জন্য বেশী সময় পান নি। তাই তিনি তিনশত তের জন সাহাবী নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। তাদের কাছে ছিল দুইটি ঘোড়া এবং সত্তরটি উট। লোকেরা পালাক্রমে আরোহন করতেন।

ঐ দিকে আক্রমণের আশঙ্কায় কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান যাত্রাপথে সাক্ষাত লাভ করা বিভিন্ন কাফেলাগুলির কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলেন। ফলে তিনি মুসলিমদের আক্রমণের খবর পান। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠানো হয়। সে দ্রুত মক্কা পৌছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী উটের নাক চাপড়ায়, আসন উল্টিয়ে দেয়, নিজের জামা ছিড়ে ফেলে এবং উটে বসে ঘোষণা করে যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে পারে।

"কুরাইশগণ, কাফেলা আক্রান্ত, কাফেলা আক্রান্ত। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের সম্পদ রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীরা এগিয়ে আসছে। তাই আমার মনে হয় না যে তোমরা তা পাবে। তাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো ”

—মক্কায় পৌছানোর পর জমজম ইবনে আমর গিফারির আহ্বান.

এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন শুরু হয়। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম‌ ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত।

আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়।উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের বের হওয়ার অবস্থা বর্ণনা করে বলেন-

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

‘‘আর তাদের মত হয়ে যেয়োনা, যারা বের হয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোকদেরকে দেখাবার উদ্দেশ্যে। আর আল্লাহর পথে তারা বাধা দান করত। বস্ত্ততঃ আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে সে সমস্ত বিষয় যা তারা করে’’। (সূরা আনফাল-৮:৪৭) সুতরাং পূর্ব প্রস্ত্ততি ছাড়াই আল্লাহ্ তা‘আলা উভয় দলকে মুখোমুখী করে দিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ‘‘এমতাবস্থায় যদি তোমরা পারস্পরিক অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে, তবে তোমরা মতবিরোধে লিপ্ত হতে’’। (সূরা আনফাল-৮: ৪২)

যাই হোক নাবী (ﷺ) যখন কুরাইশদের বের হওয়ার কথা জানতে পারলেন, তখন সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন।

সেই পরামর্শ সভায় মুহাজিরগণ প্রথমে কথা বললেন এবং অত্যন্ত সুন্দর পরামর্শ দিলেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয়বার পরামর্শ চাইলেন। এবারও মুহাজিরগণই কথা বললেন। তৃতীয়বার পরামর্শ চাইলেন। এতে আনসারগণ বুঝতে পারলেন যে, নাবী (ﷺ) তাদেরকে উদ্দেশ্য করছেন এবার তাদের পরামর্শ শুনতে চাচ্ছেন। তাই সা’দ বিন মুআয উঠে দাঁড়ালেন এবং আনসারদের পক্ষ হতে তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কথাগুলো বললেন। তিনি তাতে রসূল (ﷺ) কে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, আনসারগণ যুদ্ধ করার জন্য পূর্ণ প্রস্ত্তত রয়েছেন। সা’দ বিন মুআয বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনি সম্ভবত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। আপনি যদি আমাদেরকে ঘোড়া ছুটিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাহলে আমরা তাই করব। আপনি আমাদেরকে যেখানে যেতে বলেন, আমরা সেখানেই যাবো। এমন কি বারাকুল গামাদ (লোহিত সাগরের অপর প্রামেত্মর একটি অঞ্চলের নাম) পর্যন্ত যেতে বলেন, তাহলে আমরা সেখানে যেতেও দ্বিধাবোধ করবনা। মিকদাদ বিন আসওয়াদও অনুরূপ কথা বললেন- মিকদাদ (রাঃ) বললেন- মুসা (আঃ) এর অনুসারীরা যেরূপ বলেছিল আমরা সেরূপ বলবনা। তারা মুসাকে বলেছিল- আপনি এবং আপনার প্রভু তাদের (শত্রুদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব। আর আমরা বলছিঃ আমরা আপনার ডানে, বামে সামনে এবং পিছনে তথা চতুর্দিক থেকেই যুদ্ধ করব। সাহাবীদের কথা শুনে বিশেষ করে এই দুই নেতার কথা শুনে নাবী (ﷺ) খুব খুশী হলেন। তিনি বললেন- তাহলে তোমরা আগে বাড়, সামনে চল এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ্ আমাকে কাফেরদের দুই দলের একটির উপর বিজয় দান করার ওয়াদা করেছেন। আর আমি কাফের নেতাদের নিহত হওয়ার স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি।

এরপর নাবী (ﷺ) সামনে চলতে লাগলেন এবং বদর প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি যখন মুশরিকদের মুখোমুখী হলেন এবং উভয় দল পরস্পরকে দেখতে পেল, তখন রসূল (ﷺ) আল্লাহর দরবারে উভয় হাত তুলে দু’আ করতে লাগলেন এবং তাঁর প্রভুর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। মুসলমানেরাও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলেন এবং আল্লাহর মদদ চাইলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা এ সময় কুরআনের এই আয়াত নাযিল করলেন-

إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ

‘‘তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করছিলে স্বীয় প্রভুর নিকট, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদের মঞ্জুরী দান করলেন যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব ধারাবাহিকভাবে আগত এক হাজার ফিরিস্তার মাধ্যমে’’। (সূরা আনফাল-৯)

কাফের বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় বেশি হলেও বিজয়লাভের প্রধান উপকরণ ছিল ইমানের বল; অস্ত্রবল ও সংখ্যা নয়।

নবী করিম (সা.) মুসলমানদের জিহাদ সম্বন্ধে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করলেন। যুদ্ধে জয়লাভ করা সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামাদির আধিক্যের ওপর নির্ভর করে না; বরং মহাপরীক্ষার সময় আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে ধৈর্য অবলম্বন করা এবং অটল থাকাই জয়লাভের উপায়—এ কথাগুলো তিনি উত্তমরূপে সাহাবিদের হৃদয়ঙ্গম করিয়ে দিলেন।
তিনি বদর প্রান্তরে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন, তাঁর দোয়া কবুল করে আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধে ফেরেশতা দিয়ে মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে, “এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সহায়তা করবেন?” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং সাবধান হয়ে চলো, তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৪-১২৫)
আরবের তৎকালীন প্রথাগত যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রথমে সংঘটিত মল্লযুদ্ধে মুসলিম বীরযোদ্ধাদের হাতে কাফের বাহিনী পরাজিত হয়। এরপর হক ও বাতিলের, নূর ও জুলুমাতের, ইসলাম ও কুফুরের উভয় বাহিনী পরস্পর সম্মুখীন। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বীরবিক্রমে লড়াই করে ইসলামের বিজয় কেতন ছিনিয়ে আনেন। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় যুদ্ধ করবে, শহীদ হবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (বায়হাকি) এমন আশ্বাসবাণী পেয়ে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান জানবাজি রেখে কাফেরদের মোকাবিলায় জয়লাভ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে ৭০ জন কাফের নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। অন্যদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম বীর সেনা শহীদ হন; কাফেরদের বহু অস্ত্র ও রসদপত্র মুসলমানদের হস্তগত হলো।


দেশের সার্বভৌমত্ব অর্জন ও স্বদেশ রক্ষায় জীবনদানকে মহানবী (সা.) শাহাদতের সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে শহীদদের মর্যাদা ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের কখনোই মৃত মনে কোরো না, বরং তারা জীবিত ও তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে জীবিকাপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯) আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য ও মাতৃভূমি সুরক্ষার জন্য যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন, তাঁদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয়, তাদের মৃত বোলো না, তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৪) বদরের যুদ্ধে নিহত শহীদদের সম্পর্কে লোকেরা যখন বলাবলি করছিল যে ‘অমুকের ইন্তেকাল হয়েছে, সে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে’ তখন তাদের মন্তব্যের জবাবে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।


১৭ রমজান বদর যুদ্ধ থেকেই আরম্ভ হয় ইসলামের মহাজয় যাত্রা। তওহিদ ও ইমান যে এক অজেয় শক্তি, এর সামনে যে দুনিয়ার সব শক্তিই মাথা নত করতে বাধ্য, এ কথা মুসলমানরা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন। সত্যাসত্যের পার্থক্য দিবা ভাস্করসম উজ্জ্বলরূপে মানব হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বস্তুত, বদর যুদ্ধ ছিল ইমানের মহাপরীক্ষা। এতে রোজাদার সাহাবিরা যেভাবে কৃতিত্বের সঙ্গে সফলকাম হতে সক্ষম হয়েছেন, জগতের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সাফল্যের অপূর্ব বিজয়গাথা ইসলামের ত্যাগের শিক্ষায় সত্য ও ন্যায়ের পথে মুসলমানদের যুগ যুগ ধরে প্রাণশক্তি জুগিয়ে আসছে।

Previous Post
Next Post
Related Posts