বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান মহাকবি কায়কোবাদ


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান মহাকবি কায়কোবাদ। তিনিই আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ধারার শেষ কবি। তিনি বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী, ‘কায়কোবাদ’ তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম। ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে কায়কোবাদ জন্মগ্রহণ করেন আর তিনি  ২১ জুলাই ১৯৫১ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বাবা শাহামাতুল্লাহ আল কোরেশী ছিলেন ঢাকার জেলা-জজ আদালতের উকিল।


কায়কোবাদ ঢাকার পোগোজ স্কুল এবং সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঢাকা মাদ্রাসায় এন্ট্রান্স পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কিন্তু পরীক্ষার আগেই পোস্ট-মাস্টারের চাকরি নিয়ে তিনি স্বগ্রাম আগলায় চলে যান। সমগ্র চাকরি জীবনে তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন এবং এখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

আজহার ইসলাম বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত একুশের স্মারকগ্রন্থ ‘৯৭ এ কায়কোবাদের কাব্যে ধর্মীয় অনুভূতি সর্ম্পকে বলেছেন, ‘মীর মশাররফ, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হকের মধ্যে কায়কোবাদই হচ্ছেন সর্বতোভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তাঁর মধ্যেই লীলাময় হয়ে ওঠে। সেজন্য একথা বেশ জোরের সঙ্গে বলা যায় যে কবি কায়কোবাদই হচ্ছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি।’

তিনি বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। কাজী মোতাহার হোসেনের প্রবন্ধ সংগ্রহে লিখেন ভাষায় “কায়কোবাদের কবিতা শুধু শব্দের কৌশলময় গাঁথুনী নয়, -প্রাণের তলদেশ থেকে উৎসারিত। তাই প্রাণের উপর এর ক্রিয়া হয়- তাইতেই এতে এত মাদকতা। স্বতঃউৎসারিত ভাবাবেগ কাব্যরূপে প্রকাশিত হয়ে যে রসের সৃষ্টি করে তা বড়ই উপভোগ্য- সে যেন কাব্যের দশমরসরূপী প্রাণরস।”

আহমেদ শরীফ রচনাবলীর প্রাগুক্ততে কবি কায়কোবাদ সর্ম্পকে বলেন, ‘অতীতমুখী স্বধর্মীয় গৌরব-গর্বী বাঙালী শিক্ষিত কেবল হিন্দু কিংবা মুসলমান হয়েছে- কখনো বাঙালী হয়নি। তিনি আরও্ বলেন, কায়কোবাদের রচনায় ভাব-চিন্তার ক্ষেত্রে রয়েছে সমকালীনতা আর দৃষ্টি ও কামনার জগৎ হয়েছে ফেলে-আসা সুদূর ও অদূর অতীত। ধর্মচেতনায় কায়কোবাদ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। এই আঅসাম্প্রদিকতাই তাঁকে, যাঁরা নিজেদের রচনায় নির্বিচারে মুসলমানত্ব প্রচারে নিয়োজিত থাকতেন, তাঁদের কটু সমালোচনার সম্মুখীন করে।

কায়কোবাদ গীতি কবিতা দিয়ে তাঁর কবি-জীবনের সূচনা করেন। তবে তার কবিতায় দু’টি ধারা লক্ষ করা যায়: ১) গীতি কবিতা ও ২) কাহিনীকাব্য । কায়কোবাদ বাংলার অপর দুই মহাকবি  হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের ধারায় মহাকাব্য রচনা করেন। তবে নবীনচন্দ্রই ছিলেন তাঁর প্রধান আদর্শ। কায়কোবাদের মহাশ্মশান হচ্ছে মহাকাব্য। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ অবলম্বনে রচিত এ কাব্যে জয়-পরাজয় অপেক্ষা ধ্বংসের ভয়াবহতা প্রকট হওয়ায় এর নাম হয়েছে ‘মহাশ্মশান’। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা এবং এর দ্বারাই তিনি মহাকবিরূপে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গীতিকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে।

অতি অল্পবয়স থেকে কায়কোবাদের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য বিরহবিলাপ (১৮৭০) প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ :  কুসুম কানন (১৮৭৩); অশ্রুমালা (১৮৯৬); মহাশ্মশান (১৯০৪) [এটি তারঁ রচিত মহাকাব্য] শিব মন্দির (১৯২১); অমিয় ধারা (১৯২৩); শ্মশানভষ্ম (১৯২৪); মহররম শরীফ (১৯৩৩); মহররম শরীফ’ কবির মহাকাব্যোচিত বিপুল আয়তনের একটি কাহিনী কাব্য।শ্মশান ভসন (১৯৩৮) “এর মধ্যে ৬টি কাহিনীকাব্য রচনা করেছেন:  ১.মহাশশ্মান (১৯০৫), ২. শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি কাব্য (১৯২১) ৩. মহরম শরিফ বা আত্মবিসর্জন কাব্য (১৯৩৩), ৪. শশ্মান-ভস্ম (১৯৩৮), ৫. প্রেমের রাণী (১৯৭০), ৬. প্রেম পারিজাত (১৯৭০), (একুশের স্মারকগ্রন্থ ১৯৯৯ – কায়কোবাদের আখ্যানকাব্য – পৃথ্বীলা নাজনীন)
কবির মৃত্যুর বহুদিন পরে প্রেমের ফুল (১৯৭০), প্রেমের বাণী (১৯৭০), প্রেম-পারিজাত (১৯৭০), মন্দাকিনী-ধারা (১৯৭১) ও গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ (১৯৭৯) প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমী কায়কোবাদ রচনাবলী (৪ খন্ড, ১৯৯৪-৯৭) প্রকাশ করেছে।

মুসলমান কবি রচিত জাতীয় আখ্যান কাব্যগুলোর মধ্যে সুপরিচিত মহাকবি কায়কোবাদ রচিত ‘মহাশ্মশান’ কাব্যটি। কায়কোবাদের মহাকবি নামের খ্যাতি এই মহাশ্মশান কাব্যের জন্যই। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে ঊনত্রিশ সর্গ,দ্বিতীয় খন্ডে চব্বিশ সর্গ, এবং তৃতীয় খন্ডে সাত সর্গ। মোট ষাট সর্গে প্রায় নয়শ’ পৃষ্ঠার এই কাব্য বাংলা ১৩৩১, ইংরেজি ১৯০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়; যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশ হতে আরো ক’বছর দেরী হয়েছিল। একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধযজ্ঞকে রূপায়িত করতে গিয়ে কবি বিশাল কাহিনী,ভয়াবহ সংঘর্ষ, গগনস্পর্শী দম্ভ,এবং মর্মভেদী বেদনাকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। বিশালতার যে মহিমা রয়েছে তাকেই রূপ দিতে চেয়েছিলেন এই কাব্যে।

পুরস্কার ও সম্মাননা :  ১৯৩২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা কাব্যসাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাঁকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ ও ‘সাহিত্যরত্ন’ (১৯২৫) উপাধিতে ভূষিত করে। বাংলাদেশ সরকার তার সম্মানে ১৯৯১ সালে ৬ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
Previous Post
Next Post
Related Posts