রাফি ইবনে উমাইর রা. মরুর বালুকণা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ, আর মরুর পথঘাট বিষয়েও সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
রাফি ইবনে উমাইর রা.-কে চিনেন? জাহেলী যুগে (ইসলামের গ্রহনের পূর্বে) তিনি ছিলেন আরবের দস্যু। তার ছিল না কোনো বাহিনী অথবা তাকে সাহায্য করার জন্য কোনো দল। নিজেকেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজের সেনাবাহিনী রূপে। আরবের বিভিন্ন পরিবারের ওপর লুটপাট চালাতেন একদম একা!… দামি দামি সম্পদ ছিনতাই করে নিরাপদে ফিরে আসতেন।[১]
এ তো ছিল রাফি ইবনে উমাইর রা.-এর জাহেলী যুগের কথা…
এবার তাহলে ইসলাম গ্রহনের পরের ঘটনা শুনুন……
খলিফতুল মুসলিমিন আবু বকর রা. সেনাদল পাঠিয়েছিলেন শাম দেশে রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।[২]
মুসলিম বাহিনীকে রোমান বাহিনী প্রথমে গণনাতেই ধরেনি। কিন্তু যখন দেখল, ওই সেনাদল একের পর এক তাদের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে যাচ্ছে… তখন তাদের টনক নড়ল। তারা সকল শহর থেকে সেনা সাহায্য তলব করল। এভাবে আড়াই লক্ষের একটি ফৌজ গঠন করে ফেলল!…
মুসলিম বাহিনীর সেনা সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিল এবং খলিফার কাছে সেনা সাহায্য চেয়ে দূত পাঠাল।[৩]
ঠিক সেদিন মদিনা থেকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রা.-কে বার্তা পাঠানো হলো দ্রুত অর্ধেক সিপাহি নিয়ে শাম রণাঙ্গনে রওয়ানা হতে, তখন তিনি ছিলেন ইরাক অভিযানে পারস্য অগ্নিপূজারিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।
খালিদ রা. পত্রপাঠ মাত্র নয় হাজার মুজাহিদকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন।[৪]
শামে পৌঁছানোর জন্য খালিদ রা.-এর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোমান বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মুসলিম বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়া। তিনি এই কাজের জন্য তার বাহিনীকে তলব করলে রাফি ইবনে উমাইর রা. নিজেকে করেন।[৫]
এরপর রাফি রা. তার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। তিনি খালিদ রা.-এর কাছে বড়, মোটা ও বয়স্ক বিশটা উটনীর ব্যাবস্থা করতে বললেন। তাকে বিশটা উষ্ট্রী দেওয়া হলে তিনি সেগুলোকে তৃষ্ণার্ত বানালেন। খুব তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যাওয়ার পর সেগুলোকে নিয়ে পেটভরে পানি পান করালেন। এরপর সকল উটনীর ঠোঁট কেটে দিলেন এবং রশি দিয়ে মুখ বেঁধে দিলেন, যেন যাবর কাটতে না পারে।[৬] এরপর সব উটনীর পিঠে যতটা সম্ভব পানির বোঝা চাপিয়ে দিলেন।
❝এবার সেনাদল যাত্রা শুরু করল। দ্রুতগতিতে অবিরাম চলতে থাকল। যখনই যাত্রা বিরতি করতেন, রাফি ইবনে উমাইর রা. চারটি উটনী জবাই করতেন। সেই চার উটনীর পাকস্থলী থেকে পানি নিয়ে দুধ মিশিয়ে সব ঘোড়াকে পান করান। আর সৈনিকদের খাওয়ান সেই জবাইকৃত চার উটনীর পিঠের পানি।❞
সেনাদল যখন সফরের পাঁচ দিন অতিক্রম করলেন এবং সকল পানি শেষ হয়ে গেল। সকল সেনা পিপাসায় কাতর হয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সেই সময়ই আল্লাহর ইচ্ছায় রাফি রা. এর চোখে মারাত্মক প্রদাহ দেখা দেয়, তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না।
নিরুপায় হয়ে খালিদ রা. রাফি ইবনে উমাইর রা.-কে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন। রাফি রা. বললেন, ❝চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, দুই স্তনের মতো আকৃতির দু'টি পাহাড় দেখতে পাওয়া যায় কি না?❞
খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. চতর্দিকে তাকিয়ে দেখে বললেন— “হ্যা, রাফি… ওইতো আছে, ওইখানে দেখা যাচ্ছে।”[৭]
রাফি রা. বললেন— “ওই দুই পাহাড়ের মাঝে একটি ‘আওসাজ’ গাছ আছে। বেগুন গাছের মতো কাঁটাযুক্ত। সেই গাছ খুঁজে বের করুন।”[৮]
সবাই মিলে খুঁজলেন কিন্তু কেউ আওসাজ গাছটি খুঁজে বের করতে পারলেন না।
রাফি রা. বললেন, “বোকার দল, গাছটি এখানেই আছে। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতেই হবে। যদি বের করতে না পারো, তাহলে তোমরাও মরবে আমাকেও মারবে।”
এরপর পুরো বাহিনী আরও গভীরভাবে দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষনপর মধ্যেই পেয়ে গেলেন আওসাজ গাছের সন্ধান। সকলে সমস্বরে চিৎকার করে আল্লাহু আকবার বলে উঠলেন। রাফি ইবনে উমাইর রা. বললেন, ‘ওই গাছের গোড়ায় মাটি খনন করো।’
সবাই মিলে খনন করল.… তার নিচ থেকে স্বচ্ছ-নির্মল, সুমিষ্ট পানির ঝরনাধারা বেরিয়ে এল। সকলেই খুশিতে তাকবির-তাহলীল ধ্বনি দিতে থাকল। [৯]
খালিদ রা. অবাক হয়ে গেলেন যে, রাফি রা. এখানে পানি থাকার সম্ভবনা কী করে অনুমান করলেন! তার প্রশ্নের উত্তরে রাফি রা. জানালেন যে, ‘আমি শৈশবে একবারই আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে এ পথ দিয়ে গিয়েছি। তখন এই গাছের নিচে একটি ঝরনা প্রবাহিত ছিল।’[১০]
সবাই তৃপ্তি সহকারে পানি পান করে সামনে অগ্রসর হলেন। পঞ্চম দিন সহিহ সালামতে এই মৃত্যুর বিভীষিকাময় প্রান্তর পাড়ি দিয়ে এমন নিঃশব্দে শাম সীমান্ত অতিক্রম করলেন যে, শত্রুপক্ষের কানে টুঁ শব্দও পৌছুল না।[১১]
খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রা. শাম পৌঁছেই রোমানদের কয়েকটি শহর জয় করেন।[১২] অবশেষে রোমানদের সাথে ১ম ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিজয় মুসলিমদের পদচুম্বন করে। যা ছিল রোমানদের সাথে মুসলিমদের ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রোমান বাহিনীর সৈন্য ছিল দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার (২ লক্ষ ৪০ হাজার)।
যুদ্ধটি ছিল উমার ফারুক রা.-এর শাসনামলে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ এবং আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর ইনতিকালের ৬ দিন পর।[১৩]
তথ্যসূত্রঃ
[১] সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা., ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, খ.২ পৃ.৪৫৩-৪৫৪;
[২] মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২১৬, ২১৯, ৪৩৯; https://www.ihistory.pro/search-event.php?search-event-id=22
[৩] প্রাগুক্ত, পৃ.২২০;
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা., ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, খ.২ পৃ.৪৫৮-৪৫৯;
[৪] প্রাগুক্ত, পৃ.২২০, ৪৩৯;
https://www.ihistory.pro/search-event.php?search-event-id=24
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী সৈন্য সংখ্যা ছিল দশ হাজার।
[সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা., ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, খ.২ পৃ.৪৫৯]
[৫] সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা., ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, খ.২ পৃ.৪৬০;
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী খালিদ রা. নিজেই তাকে রাহবার নিযুক্ত করেছিলেন।
[মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২২০]
[৬] এখানে কেউ যেন মনে না করে উটগুলোর উপর জুলুম করা হয়েছে। কেননা রোমানদের বিরুদ্ধে লড়াইরত মুসলিম বাহিনী ছিল সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় এবং তাদের সাহায্যের জন্য রোমান বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার জন্য মরুভূমির পথ ধরা ছিল অনিবার্য। আর সেখানে বাঁচতে হলে কৌশল অবলম্বনের বিকল্প নেই। আর যদি সত্যিকার অর্থে জুলুম করাই হতো তাহলে মুসলিম বাহিনীতে থাকা বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম তার বিরোধীতা করত।
[৭] সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা., ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, খ.২ পৃ.৪৬৩;
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী রাফি রা. নিজেই কাফেলাকে একথা বলছিলেন এবং সেখানে পাহাড়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু গাছের কথা এসেছে।
[মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২২১]
[৮] প্রাগুক্ত, পৃ.৪৬৩;
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী রাফি রা. গাছটির নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, 'গাছটি দেখতে দূর থেকে মানুষ বসে আছে বলে মনে হবে।'
[মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২২১]
[৯] প্রাগুক্ত, পৃ.৪৬২-৪৬৪;
[১০] মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২২১;
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা. গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী রাফি রা. নিজেই একথা বলেছেন।
[সাহাবায়ে কেরামের ঈমানদীপ্ত জীবন রা., ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা, খ.২ পৃ.৪৬৪]
[১১] আল-কমিল ফিত তারিখ, ইবনু আসির রহ., ১৩ হিজরি শিরোনামের অধীনে।
[সূত্রে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২২১ টী.২]
[১২] মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ, খ.২, পৃ.২২২;
https://www.ihistory.pro/search-event.php?search-event-id=26
[১৩] প্রাগুক্ত, পৃ.২৩৮-২৪৩;
https://www.ihistory.pro/search-event.php?search-event-id=29
লিখেছেন— রিদওয়ান নাবিল