১.যুদ্ধের ঘটনা :
সুলতান মুহম্মদ ঘুরী তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মোটেই বিচলিত হলেন না। বরং তিনি ধৈর্য ও অধ্যাবসায় তার পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যেতে থাকলেন।তিনি পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করবার জন্য ব্যগ্র হইয়া শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠনে মনোনিবেশ করলেন। তাই পরের বৎসরই ১১৯২ খ্রীস্টাব্দে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পুনরায় তরাইনের প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। মুহম্মদ ঘুরীর বিশাল বাহিনীর সংখ্যা ছিল এক লক্ষ কুড়ি হাজার, অশ্বারোহীর সংখ্যা ছিল বার হাজার।ঐতিহাসিক কাসিম ফিরিশতার মতে, পৃথ্বীরাজের সাথে উত্তর ভারতের ১৫০ জন রাজপুত যুবরাজ যোগ দেয়।তার বাহিনীর সৈন্য ছিল প্রায় ৩ লাখ। পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে ভারতীয়দের সম্মিলিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুহম্মদ ঘুরীর সৈন্যবাহিনীর তরাইনের প্রান্তরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল।
সুলতান মুহম্মদ ঘুরী রাজপুতদের এই মিলিত বাহিনীকে তীব্র আক্রমণ করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলেন ।যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নরত পৃথ্বীরাজ মুসলিমদের হস্তে বন্দী ও নিহত হন।প্রথম তরাইনের যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরীর আহতকারী খাদি রায় এবং পৃথ্বীরাজের ভ্রাতা গোবিন্দ রায়ও এ যুদ্ধে
নিহত হন। কনৌজের রাজপুত রাজা জয়চন্দ্র পৃথ্বীরাজের প্রতি ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে সম্মিলিত হিন্দু বাহিনীতে যোগ না দিয়ে বরং মুহম্মদ ঘুরীকে সহায়তা করেন।
২.যুদ্ধের গুরুত্বঃ
রাজপুত বীরত্ব মুসলিম সৈন্যবাহিনীর নিকট পরাভূত হল। হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও মুসলিমদের নিকট পরাজিত হল। হিন্দুদের চিরাচরিত যুদ্ধরীতি, সর্বোপরি মিলিত বাহিনীর পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীভূত একক অধিনায়কত্বের অভাব তাহাদের পরাজয়ের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ এক যুগান্তকারী ঘটনা।' তরাইনের যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে ভি. ডি. মহাজন বলেন, “ভারতবর্ষের ইতিহাসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ একটি বিখ্যাত ঘটনা। এটা ভারতীয় রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরীর চূড়ান্ত সফলতা সুনিশ্চিত করে।”
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তিস্তম্ভস্বরূপ ছিল। এ যুদ্ধে রাজপুতগণ সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হলে তাদের শক্তির অজেয়তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। এ যুদ্ধ মুসলিম সেনাপতি এবং সৈনিকদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। হেগ বলেন, “তরাইনের বিজয় উত্তর ভারতে দিল্লী পর্যন্ত সমস্ত শহরের ফটক মুহম্মদ ঘুরীর জন্য উন্মোচিত করে দেয়।”
৩.যুদ্ধের ফলাফল :
হিন্দুদের এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে উত্তর ভারত তুর্কী মুসলিমদের অধিকারে আসল। মুসলিম অধিকার প্রায় দিল্লীর উপকণ্ঠ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের এই বিজয় এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্সি, সামান, গুহরাম ও অন্যান্য কয়েকটি সুরক্ষিত দুর্গ মুহম্মদ ঘুরীর নিকট আত্মসমর্পণ করিল আজমীর রাজ্য মুহম্মদ ঘুরী দ্বারা অধিকৃত হলেও আজমীর নগরটি বাৎসরিক করদানের শর্তে পৃথ্বীরাজের পুত্রের শাসনাধীনে রাখা হল।গজনীতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে বিজয়ী মুহম্মদ ঘুরী তাঁহার বিশ্বস্ত সৈন্যাধ্যক্ষ কুতুবউদ্দীনকে ভারতীয় বিজিত রাজ্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া গেলেন। কুতুবউদ্দীন আইবেক তাঁহার সামরিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা ভারতে তুর্কী সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। অতি অল্পকালের মধ্যে ১১৯৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি দিল্লী জয় করিলেন এবং ক্রমে গোয়ালিয়র, আনহিলওয়ার, কনৌজ প্রভৃতি অধিকার করিয়া মুসলিম অধিকৃত রাজ্যের বিস্তার সাধন করলেন।
পরবর্তীতে ১২০৬ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৫২৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।
গ্রন্থ :
ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, প্রফেসর এ.কে.এম. আব্দুল আলিম।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, প্রফেসর আব্দুল করিম।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, হাসান আলি চৌধুরী।