বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও পন্ডিত ইবনে রুশদ।


অজ্ঞতা থেকে ভীতি তৈরি হয়, ভীতি ঘৃণার সৃষ্টি করে আর ঘৃণা থেকে আসে হিংস্রতা। এটাই নিয়ম।”
– ইবনে রুশদ

প্রারম্ভিকাঃ

আমাদের আজকের এ সমাজব্যবস্থা আস্তিক আর নাস্তিক এই দু’ভাগে খণ্ডিত। তারা নির্দিষ্ট করে নিয়েছে ধর্ম মানলে বিজ্ঞান বা দর্শন মানা যাবে না, আর বিজ্ঞান বা দর্শনতত্ত্ব মানলে ধর্ম মানা যাবে না। অথচ বিজ্ঞানের জগতে যখন তোলপাড় জাগতে শুরু করেছে, মুসলিমরাই তখন অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ছিল মুসলিমদের আধিপত্য। এমনি একজন মুসলিম দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবীদ, জ্যোতির্বিদ ইবনে রুশদ; যিনি ধর্ম আর দর্শনের মাঝে সেতু বন্ধন তৈরি করে গেছেন।

অষ্টম শতক পর্যন্ত আরবে গ্রীক দর্শনকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। দর্শন ধর্মের সাথে সংঘাতপূর্ণ বলেই ভাবা হতো। তবে মুতাজিলা (যারা দর্শনকে ধর্মের সাথে সংঘাতপূর্ণ ভাবতো না) ধর্মতত্ত্বের প্রবর্তনে গ্রীক দর্শন কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পায়। অষ্টম থেকে ১২শ শতাব্দী হলো অষ্টম প্রাথমিক ইসলামী দর্শনের ব্যাপ্তিকাল। এ সময়কে ইসলামী স্বর্ণযুগ বলা হয়।

দার্শনিক আল কিন্দি এর সূচনা করেছিলেন এবং ইবনে রুশদের হাতে এই প্রাথমিক সময়টির সমাপ্তি ঘটে।

কিন্তু এর মাঝে ইমাম আবু আল হাসান আল আশ’আরী প্রবর্তিত ‘আশ’আরী’ তত্ত্ব নতুন করে দর্শন বিরোধিতা শুরু করে এবং সবধরনের যুক্তি-তর্ক আর প্রশ্ন করার ব্যাপারটিকে তারা ‘অবিশ্বাস’ বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। ইবনে রুশদ এমনই এক প্রতিকূল পরিবেশে নিজের দর্শন রচনা করে গেছেন। তিনি অবশ্যই কুরআনকে সত্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেছেন যে কুরআনের অনেক কিছুই গভীর অর্থবহ, যা বুঝতে হলে দর্শনের প্রয়োজন। তিনি যে রাজবংশের হয়ে রাজনীতি করেছেন, সে বংশের উদার পৃষ্ঠপোষকতাই তাকে তার দর্শন নিয়ে এগোতে সহায়তা করেছে।

মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও পন্ডিত হিসেবে ইবনে রুশদের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া।  তবে এই দর্শনের জন্যই তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল কালো মেঘের ঘনঘটা।

ক্রমশ বাড়তে থাকা তার উদারবাদী দর্শন বিরোধী আন্দোলনের মুখে তাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে নির্বাসনের পূর্বেই রুশদ তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘ডিসিসিভ ট্রিটিজ’ রচনা করে ফেলেছিলেন।

জন্মঃ

তিনি কর্ডোবায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে১৪ এপ্রিল ১১২৬ (৫২০ হিজরী) সালে জন্মগ্রহণ করেন। 

তাঁর পরিবার শহরের লোকপ্রসাশন সংক্রান্ত কাজ, বিশেষত বিচার ও ধর্মীয় বিষয়ে জড়িত থাকার কারণে সুপরিচিত ছিলো। তাঁর পিতামহ আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ (মৃত্যুঃ১১২৬)আল মোরাভি কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি(কাজি) ও কর্ডোবার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ছিলেন।তাঁর পিতা আবুল কাসিমও পরবর্তীতে কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি ছিলেন,১১৪৬ সালে আল-মোহাদ রাজবংশ আল-মোরাভিদের স্থলাভিষিক্ত হলে তাকে পদচ্যুত করা হয়।

তার পুরো নামঃ

আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবন রুশদ (আরবি: أبو الوليد محمد ابن احمد ابن رشد‎, ১৪ এপ্রিল ১১২৬- ১১ ডিসেম্বর, ১১৯৮) বা সংক্ষেপে ইবনে রুশদ । তিনি পাশ্চাত্যে সমধিক পরিচিত Aveross নামে।

শিক্ষালাভঃ

তার জীবনীকারদের মতে ইবন রুশদের শিক্ষাজীবন ছিলো অসাধারণ। হাদিসশাস্ত্র হতে শুরু করে, ফিকহ, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন।

তিনি মালিকি ফিকহ শিখেছিলেন আল-হাফিজ আবু মুহম্মদ ইবন রিযক এর কাছে, হাদিসশাস্ত্রের পাঠ নিয়েছেন তাঁর পিতামহের এক শিষ্যের কাছে। তাঁর পিতামহও তাকে ফিকহ এর জ্ঞান দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ইমাম মালিকের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম মুয়াত্তার পাঠ দিয়েছিলেন। তিনি আবু-জা'ফর জারিম আল-তাজাইল এর নিকট চিকিৎসার জ্ঞান লাভ করেন, যিনি সম্ভবত তাঁকে দর্শন এর দীক্ষাও দিয়েছেন।

তিনি দার্শনিক ইবন বাজা এর লেখনীর সম্পর্কেও অবগত ছিলেন, খুব সম্ভবত তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন অথবা তাঁর ছাত্রত্বেও থেকে থাকতে পারেন। তিনি নিয়মিতই সেভিল এ অনুষ্ঠিত দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ ও কবিদের সভায় উপস্থিত থাকতেন, এ সভা সেসময়কার বিখ্যাত দার্শনিক ইবন তুফায়েল ও চিকিৎসাবিদ ইবন যুহর অংশগ্রহণ করতেন। তিনি আশ'আরী মতের কালাম ধর্মতত্ত্ব পড়েছিলেন, যার সমালোচক হিসেবে পরবর্তী জীবনে তিনি অবতীর্ণ হন।

এছাড়াও তিনি লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন দুই বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে। এরা হচ্ছেন : আবু জাফর হারুন এবং ইবনে রাজা। তিনি সুযোগ পান কর্ডোভা পাঠাগারে পড়াশোনার। এই পাঠাগারে ছিল ৫ লাখ বইয়ের সমাহার। এই বিপুল সংগ্রহের অনেক মৌলিক বই তিনি সেখানে পাঠ করেন। এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন আল হাকাম। তিনি ছিলেন স্পেনের উমাইয়া বংশীয় বিখ্যাত খলীফা। তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হলে তাকে ডেকে নেয়া হয় মরক্কোতে। আর ইয়াকুব সেখানে তাকে তাঁর চিকিৎসক পদে নিয়োগ দেন। তিনি ইবনে তোফায়েলের স্থলাভিষিক্ত হন।

গৌরবময় কর্মজীবনঃ

১১৫৩ সাল নাগাদ ইবন রুশদ আল-মোহাদ খেলাফতের রাজধানী মারাক্কেশ এ অবস্থান করছিলেন।সম্ভবত মারাক্কেশে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি বিখ্যাত দার্শনিক ও হায়্যি ইবন ইয়াকযান এর রচয়িতা ইবন তুফায়েল এর সাথে দেখা হয়েছিলো। ইবন তুফায়েলও তখন মারাক্কেশে রাজসভার চিকিৎসক ছিলেন। তাঁদের দুজনার মতভিন্নতা থাকলেও তাঁরা একে অপরকে বন্ধুত্বে বরণ করেছিলেন। ১১৬৯ সালে ইবন তুফায়েল ইবন রুশদকে আল-মোহাদ খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফের সাথে পরিচয় করান।

শিক্ষানুরাগী খলিফা ইবন রুশদের প্রতিভায় রীতিমতো মুগ্ধ হন। তিনি ইবন রুশদের বিভিন্ন গবেষণা কর্মে সাহায্য করেন।

ইবনে রুশদ ১১৬৯ খ্রীস্টাব্দে সেভিলের এবং ১১৭১ খ্রীস্টাব্দে কর্ডোভার কাজীর পদ লাভ করেন। তিনি স্পেনের আন্দালুসিয়ার কাযী-উল-কুযতের পদে নিযুক্ত হন ১১৮২ খ্রীস্টাব্দে।

১১৮৪ সালে আবু ইউসুফের মৃত্যুর পরও তিনি বহাল থাকেন আপন পদে।খলিফার পদে অভিষেক ঘটে আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল-মানসুরের। ১১ বছর রুশদকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলো সুলতান মনসুর।রুশদ আইনে সুপণ্ডিত হলেও তার নাম ছড়িয়েছিল চিকিৎসা ও দর্শনশাস্ত্রে।

নির্বাসনঃ

পরিণত হয়ে ওঠলে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। তার মতামত প্ৰকাশ করতে গিয়ে তাঁর জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। রাজনৈতিক জটিলতা তাকে রাজরোষের কবলে ফেলে ১১৯৫ সালে। তাকে নির্বাসনে পাঠানো হলো লুসিয়ানায়।

শুধু একান্ত বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো ছাড়া তাঁর বাকি বইগুলো পুড়িয়ে দেয়া হল। তিনি নির্বাসনে কাটান চার বছর। এরই মধ্যে তাঁর ব্যাপারটি নিয়ে মধ্যস্থতায় নামলেন বেশ ক’জন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতবর। তাদের ওকালতিতে ইবনে রুশদের ওপর থেকে নির্বাসন আদেশ প্রত্যাহার করে নেন মরক্কোর শাসক। ১১৯৮ খৃষ্টাব্দে তাকে ডেকে আনা হলো মরক্কোতে।

অ্যারিস্টটলের ব্যাখ্যাকর্ম ও  ইসলামি দার্শনিক চিন্তাঃ

ইবন রুশদ অ্যারিস্টললের মতাদর্শের এক উৎসাহী সমর্থক ছিলেন; তিনি অ্যারিস্টটলের মূল শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছিলেন।আল গাজ্জালী যেখানে গ্রীক দর্শনের অশুভ প্রভাব থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন সেখানে ইবনে রুশদ এ্যারিস্টটলের দর্শনের সাথে ইসলামী মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন।

ইবনে রুশদের দার্শনিক চিন্তার বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইসলামের ধর্মীয়বোধের বিরোধিতা না করেও গ্রিসের দার্শনিক এ্যারিস্টটলের দর্শনের বস্তুবাদী দিক বিকশিত করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বস্তু এবং গতির কোনো স্রষ্টা নেই।

সে সময়ে তার নাগালে থাকা অ্যারিস্টটলের প্রায় সকল কাজের ব্যাখ্যা লিখেছিলেন। শুধুমাত্র অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রনীতি বাদে, যেটা সম্ভবত তাঁর নাগালের মাঝে ছিল না। তিনি তাই প্লেটোর রিপাবলিক এর উপর ব্যাখ্যা লিখেছিলেন।

তিনি তার ব্যাখ্যাগুলোকে কয়েকভাগে ভাগ করেছিলেন; যাকে আধুনিক পন্ডিতগণ দীর্ধ, মধ্যম ও সংক্ষিপ্ত তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর বেশিরভাগই কর্মজীবনের সূচনায় লিখিত, যেগুলো অ্যারিস্টটলের নানা মতবাদের সারসংক্ষেপ বহন করে। তার মধ্যম বক্তৃতাগুলো অ্যারিষ্টটলের মূল বক্তব্যের উদ্ধৃতি বহন এবং এর বক্তব্যকে সরলীকরণের প্রয়াস করে।

এ মধ্যবর্তী কাজ গুলো সাধারণত তার পৃষ্ঠপোষক খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফ কর্তৃক অনুযোগের কারণে লিখিত; যখন খলিফা বলেছিলেন তাঁর অ্যারিস্টটলের কাজ বুঝে উঠতে অসুবিধা হচ্ছিলো। তার দীর্ঘ ব্যাখ্যাতে প্রতি পংক্তির ব্যাখ্যা তিনি সংযোজন করেছেন, এবং এতে তার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলনও দেখা যায়; স্বভাবতই এগুলো সম্ভবত সাধারণ্যের জন্যে লিখিত ছিলো না। অ্যাারিষ্টটলের প্রধান পাঁচটি কাজেরই এধরণের তিন প্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

তাঁর মতে অ্যারিস্টটলের মূল বক্তব্য আল-ফারাবি, ইবন সিনার মতো মুসলিম দার্শনিকদের নিওপ্লাটোনিস্ট ভাবধারার কবলে পড়ে বিকৃতি লাভ করেছিলো।

তিনি দেখান যে প্লেটোর মতামত এবং অ্যারিস্টটলের মত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আল ফারাবির যুক্তিবিদ্যার কাজেরও সমালোচনা করেন মূল অ্যারিস্টটলীয় উৎসের অপব্যাখ্যা করার জন্য। ইবন সিনা, যিনি ছিলেন মধ্যযুগে ইসলামি নিওপ্লাটোনিজমের প্রধান প্রবক্তা, তাঁর সমালোচক হিসেবেও ইবন রুশদ অবতীর্ণ হন।

তিনি অ্যারিস্টটলের সঙ্গীত বিষয়ক বই De Anima’র সমালোচনা করে বই লিখেন। মিশেল দ্যা স্কট নামে জনৈক অনুবাদক। এটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন।

স্বতন্ত্র দার্শনিক কাজঃ

ইবন রুশদ স্বতন্ত্র দার্শনিক গবেষণাপত্র লিখেছেন; যার মধ্যে আছে বুদ্ধিবৃত্তির উপর, সময়ের উপর, মহাকাশীয় গোলকের উপর এবং গোলকের গতির সম্বন্ধীয়। তিনি কিছু সমালোচনামূলক গ্রন্থও লিখেছেনঃ আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা পাঠের পদ্ধতির সাথে অ্যারিস্টটলের পদ্ধতির তুলনা, ইবন সিনার কিতাব-আশ শিফা অনুসারে অধিবিদ্যা, এবং ইবন সিনার অস্তিত্বশীল সত্তার শ্রেণিকরণের বিরোধিতা।

চিকিৎসাশাস্ত্রঃ

ইবন রুশদ আল-মোহাদ খিলাফতের সভায় রাজচিকিৎসক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। সেই সুবাদে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণা করেন।

ইবনে রুশদ মানব জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন তার বিখ্যাত গ্ৰন্থ : ‘কিতাব আল কুলিয়াত ফি আল তিব্বি’’। চিকিৎসা শাস্ত্রে এটি একটি মাস্টার ওয়ার্ক।  পাশ্চাত্যে ল্যাটিনকৃত নাম কলিজেট[The Colliget] নামে পরিচিত)।

এ বই ১১৬২ সাল নাগাদ লেখা হয়েছিলো, তাঁর রাজচিকিৎসক পদে অধিষ্ঠিত হবার কিছুকাল আগে। তাঁর বইয়ের শিরোনাম সমসাময়িক আন্দালুসীয় চিকিৎসক ইবন যুহরের আল-জুযি'ইয়্যাত ফিত-তিব ( "চিকিৎসার বিশেষায়িত নীতিমালা") এর বিপরীত; মূলত তার এ কাজ ইবন যুহরের বইয়ের সাথে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে রচিত হয়েছিলো।

এতে রয়েছে চিকিৎসা শাস্ত্রের তিনটি মৌল বিষয় : রোগ বিশ্লেষণ (ডায়োগনেসিস), নিরাময় (কিউরী) এবং প্রতিরোধ (প্রিভেনশন)। বইটিতে ইবনে সিনার ‘আল-কানুন’ সম্পর্কে সর্বশেষ উল্লেখ রয়েছে।

ল্যাটিনে অনুদিত হয়ে তাঁর এ বই ইউরোপে কয়েক শতাব্দীকাল ব্যাপী চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার প্রমিত গ্রন্থরূপে ব্যবহৃত হয়েছিলো।ইবন রুশদ গ্রিক চিকিৎসাবিদ গ্যালেনের কর্মের সারবত্তা নিয়ে লিখেছেন এবং ইবন সিনার উরজুযাহ ফিত-তিব এর বিশ্লেষণ রচনা করেছেন।

দর্শনশাস্ত্র ও ইসলামঃ

দ্য ডিসিসিভ ট্রিটিজ বইয়ে তিনি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। এই বইতে দর্শন কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে আলোচনা শুরু করেছেন পবিত্র কোরআন থেকে নেয়া দুটি আয়াত দিয়ে।

ইবনে রুশদ ছিলেন উদারবাদী দার্শনিক এবং মনেপ্রাণে একজন আন্তরিক মুসলিম। তাই কোরআনকেই শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ বলে ঘোষণা দেন তিনি। তার মতে, প্রতিপাদক পদ্ধতিতে সত্য যাচাই করতে গেলে চূড়ান্ত গন্তব্যে কোরআনের কাছেই পৌঁছতে হবে। কারণ কোরআনে প্রকৃতির সত্য উদঘাটন করা হয়েছে।

ইবনে রুশদের মতে, ধর্মগ্রন্থকে তিনভাবে বিশ্লেষণ করে তা থেকে দর্শন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রতিপাদন, ন্যায়শাস্ত্রে যাচাই এবং অলংকারশাস্ত্র। আর এই তিন উপায়ে ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা করে মানবজাতি তিন শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম শ্রেণী দার্শনিকদের। দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকে ধর্মতাত্ত্বিকরা। আর সবশেষে সাধারণ মানুষের অবস্থান।

তিনি আল গাযালির মতো আশ’আরি ধর্মতত্ত্ববিদগণের সমালোচনার বিরুদ্ধে গিয়ে দর্শনের চর্চার সমর্থন করেন। ইবন রুশদ বলেন যে, দর্শনের চর্চা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে অনুমোদিত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।

তবে তার মতে যদি কোনোকিছুর প্রতিপাদন কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তবে সেটা কেবলই সাময়িক একটি ব্যাপার। ভবিষ্যতে তার সমাধানও অনিবার্য। আবার কোনো ক্ষেত্রে যদি ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ উভয়েই কোনো বিষয়ের অস্তিত্বে বিরোধ প্রকাশ করে, তবে সেক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থকে রূপকার্থে ব্যাখ্যা করতে হবে। আর রূপক শুধু দার্শনিকরা ব্যবহার করেন না, ধর্মতত্ত্ববিদরাও ব্যবহার করেন। তাই দর্শনকে ধর্মতত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক ভাবাটা যুক্তিসঙ্গত নয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞানেঃ

১১৫৩ সাল নাগাদ ইবন রুশদ আল-মোহাদ খেলাফতের রাজধানী মারাক্কেশ এ অবস্থান করছিলেন। কারণ নব্য প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদ নির্মাণ কাজে কিছু জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত হিসাব নিকাশে তাঁর কাজ করতে হচ্ছিলো। তিনি জ্যোতির্বিদ্যার সমসাময়িক গানিতিক নিয়মগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাই নতুন কিছু ভৌত সূত্র এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তবে তাঁর এ প্রচেষ্টা তখন ব্যর্থ হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানঃ

ইবন রুশদ প্লেটোর রিপাবলিক এর ব্যাখ্যাকর্মে তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্ব সংক্রান্ত চিন্তা চিত্রিত করেন। তিনি প্লেটোর চিন্তাধারার সাথে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সমন্বয় করার প্রয়াস নেন; তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে ইসলামি আইনভিত্তিক (শরিয়াহ) শাসন ব্যাবস্থায় শাসিত রাষ্ট্রের কথা বলেন। তিনি প্লেটোর দার্শনিক-রাজ এর সমান্তরাল হিসেবে আল-ফারাবিকে অনুসরণ করেন এবং বলেন একে ইমাম, খলিফা এবং আইনপ্রণেতা ফকিহ এর সাথে তুলনা করেন।

স্রষ্টার অস্তিত্বঃ

ইবন রুশদ তাঁর বই কাশফ'আন মানাহিজ আল-আদিলাহ গ্রন্থে স্রষ্টার অস্তিত্ব ও প্রকৃতি সম্বন্ধে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি ইসলামের বিভিন্ন ধারার মতবাদের পরীক্ষণ এবং সমালোচনা করেন: আশ'আরী, মু'তাজিলা, সুফিবাদী প্রভৃতি ধারার।

অন্যদিকে তিনি তিনি প্রত্যেকের স্রষ্ট্রার অস্তিত্ব সংক্রান্ত যুক্তি নিরীক্ষণ এবং সমালোচনা করেন। ইবন রুশদ মত ব্যক্ত করেন যে দু' ধরণের প্রমাণ আছে স্রষ্টার অস্তিত্ব সংক্রান্ত যেটা তিনি মনে করেন যৌক্তিকভাবে সংগতিপূর্ণ এবং কুরআন কর্তৃক সমর্থিত। প্রথমোক্তটি হচ্ছে বিশ্বের অতিমাত্রায় সুষমামন্ডিত হবার থেকে, যা জীবনকে সম্ভবপর করে তুলেছে। ইবন রুশদ সূর্য, চাঁদ নদ-নদী, সমুদ্র এবং ভূপৃষ্ঠে মানবপ্রজাতির অবস্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তাঁর মতে এটি একজন স্রষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে যিনি মানবজাতির কল্যাণের জন্য এসবের অবতারণা করেছেন। এ সংক্রান্ত তার অন্য মত টি হল 'উদ্ভাবন প্রসঙ্গে'; পৃথিবীর উপর জীব্জন্তু ও গাছপালা গুলো যেন মানুষের জন্যই কেউ উদ্ভাবন করেছে। ইবন রুশদের এ আর্গুমেন্ট গুলো টেলিওলোজিকাল ধরণের, অ্যারিস্টটল বা তাঁর সমসাময়িক মুসলিম কালামশাস্ত্রীদের মতো মহাজাগতিক তথা কসমোলজিকাল ধরণের নয়।

আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে মুসলিম দর্শনের গোড়া থেকে ‘মুতাজিলা’ ও ‘আশারিয়া’ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছিল। মুতাজিলা সম্প্রদায় আল্লাহর একত্ব নষ্ট হবে বলে আল্লাহর যে ৯৯ টি গুণাবলী আছে বলে ধারণা করা হয় তা তারা অস্বীকার করেছিলেন বা তারা আল্লাহর গুণাবলীকে একটিতে নামিয়ে এনেছিলেন। পক্ষান্তরে আশারিয়া সম্প্রদায় কোরআনে ঐশী গুণের উল্লেখ আছে বলে তা অস্বীকার করতে পারেন নি। গাজ্জালী আশারিয়াদের সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন এবং পরবর্তিকালে ‘ইবনে সিনা’ মুতাজিলাদের সমর্থণ করে বক্তব্য রাখেন। ঐশী গুণাবলী সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতামতের সাথে ইবনে সিনার মতের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তার রচনা সমগ্রঃ

তিনি নির্বাসনে যাওয়ার পূর্বে তার মূল্যবান গ্রন্থসমুহ রচনা করেন। তার গ্রন্থের বর্ণনা নিম্নরূপ—

আরবি ভাষায় দর্শনশাস্ত্রে ২৮টি, চিকিৎসা শাস্ত্রে ২০টি, ফিকাশাস্ত্রে ৬টি, জ্যোতির্বিজ্ঞানে ৮টি ও আরবি-ব্যাকরণে ২টি বই লেখা শেষ করে ফেলেন।

এছাড়াও প্রাচ্যবিদ আর্নেস্ট রেনান এর মতে ইবন রুশদের অন্তত ৬৭ টি স্বতন্ত্র রচনা বিদ্যমান; তন্মধ্যে ২৮ টি দর্শন, ২০ টি চিকিৎসাবিদ্যা, ৮ টি আইনবিদ্যা, ৫ টি ধর্মতত্ত্ব ও ৪ টি ব্যাকরণ নিয়ে, এর সাথে আছে অ্যারিস্টটলের সিংহভাগ কাজের উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্লেটোর রিপাবলিক এর উপর বক্তৃতা।

ইবন রুশদের অনেক কাজের মূল আরবি পান্ডুলিপি পাওয়া যায় নি, বেশিরভাগই শুধুমাত্র হিব্রু এবং ল্যাটিন অনুবাদের পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ অ্যারিস্টটলের উপর তার দীর্ঘ ব্যাখ্যাগুলোর খুব কম অংশের মূল আরবি পান্ডুলিপি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

স্বরণেঃ

ইবন রুশদের উল্লেখ পাশ্চাত্যে এবং মুসলিম বিশ্বে উভয় স্থানের সাংস্কৃতিক কর্মে দেখা যায়। ইতালীয় লেখক দান্তের ১৩২০ সালে লিখিত কবিতা দ্য ডিভাইন কমেডি তে অন্যান্য অ-খ্রিষ্টান গ্রিক এবং মুসলিম চিন্তক যেমন লিম্বো এবং সালাহউদ্দিন মধ্যে ইবন রুশদকে চিত্রিত করা হয়েছে "মহান ব্যাখ্যাকারী" অভিধায়। দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস(১৩৮৭) এর সূচনায় ইংরেজ কবি জেফ্রি চসার ইবন রুশদকে তৎকালীন ইউরোপের অন্যান্য মেডিকেল অথরিটির সাথে উল্লেখ করেছেন।

রাফায়েল এর ১৫০১ সালের ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্রাসাদের গায়ে চিত্রিত ফ্রেস্কো দ্য স্কুল অব এথেন্স  ; যাতে দর্শনের মহারথীদের প্রদর্শন করে, তাতে ইবন রুশদ চিত্রিত হয়েছেন। এই চিত্রকর্মে এক সবুজ আলখেল্লা পরিহিত এবং মাথায় পাগড়ি ওয়ালা ইবন রুশদ পিথাগোরাসের কাঁধ বরাবর উঁকি দিচ্ছেন, যেখানে পিথাগোরাসকে এক বই লেখার ভঙ্গিতে দেখানো হয়েছে।

উদ্ভিদের একটি গণ এভেরোয়া(Averrhoa) তার নামে নামকরণ করা হয়েছে, চাঁদের অভিঘাত খাদ ইবন-রুশদ এর নামকরণ তাঁর স্মরণে করা হয়েছে।

মৃত্যুঃ

নির্বাসনে কেটে যায় রুশদের প্রায় চারটি বছর। ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ। অনুতপ্ত সুলতান রুশদকে ডেকে পাঠালেন, মরক্কো ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। সেই সাথে কথা দিলেন রুশদের কোনো বই আর পুড়ানো হবে না।

ইবনে রুশদ সসম্মানে ফিরে গেলেন মরক্কো যেন হারানো সম্মান তার আপন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু নির্বাসনের এই মানসিক যন্ত্রণা তিনি সামলে উঠতে পারেননি। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে এবং ১১৯৮ সালের ১০ ডিসেম্বর এই ক্ষণজন্মা মেধাবী, ধর্ম ও দর্শনের সেতুবন্ধনকারী   দার্শনিক ইবনে রুশদ পরলোকগমন করেন।


তথ্য সূত্র—
১. দৈনিক নয়া দিগন্ত ২৯শে জুন ২০২১
২. দর্শনকোষ। সরদার ফজলুল করিম
৩. দেশ রুপান্তর ২৯শে মার্চ ২০১৯
৪. উইকিপিডিয়া


লিখেছেন— Raqib Hussain

Previous Post
Next Post
Related Posts