রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২২

মুতাজিলা কারা এবং কিভাবে মুতাজিলার উৎপত্তি হয় | Mutajila

স্বাধীন ইচ্ছা ও কার্যের অনুসারী কাদেরিয়াদের উত্তরাধিকারী হিসেবে মুতাজিলা গোষ্ঠী ইসলামি ধর্মতত্ত্ব দর্শনে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। মূলত হাসান আল বসরির সাহচর্য বঞ্চিত ওয়াসিল বিন আতা এবং তার অনুসারীদের দলত্যাগী বা মুতাজিলা নামে আখ্যায়িত করা হয়।


মুতাজিলা শব্দটি ‘ইতিজিলা’ শব্দ হতে উৎপত্তি হয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল সাদিকের শিষ্য ওয়াসিল বিন আতা এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রখ্যাত তাপস হাসান আল বসরির সান্নিধ্যে জ্ঞানচর্চার সুযোগ পান। উল্লেখ্য যে, হাসান আল বসরি একদিন শিষ্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন যে, কেউ যদি কবিরা গুনাহ করে তাহলে সে আর কিছুতেই মুসলিম থাকবে না, কাফির হবে। খারিজগণ এক্ষেত্রে তাকে (কবিরা গুনাহকারী) কাফির বললেও মুতাজিলা সম্প্রদায় তাকে (কবিরা গুনাহকারী) বিধর্মী মনে করেন না। হাসান আল বাসরি তার বক্তব্য পেশ করার পূর্বেই ওয়াসিল বিন আতা মন্তব্য করেন যে, এরুপ ব্যক্তি কাফিরও নয় আবার মুসলিমও নয়। এটা শুনে হাসান আল বসরি বললেন, ‘ইতিজিলা আন্না’ অর্থাৎ সে আমার দলত্যাগ করেছে। এভাবে হাসান আল বসরির সাহচর্য হতে বঞ্চিত হয়ে ওয়াসিল বিন আতা এবং তার সঙ্গীগন দলত্যাগী বা মুতাজিলা নামে পরিচিত হয়।

ইসলামে উদ্ভুত উগ্রপন্থী ও কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা প্রদানকারী দলসমূহের মধ্যে মুতাজিলা অন্যতম। মুতাজিলা সম্প্রদায় ছিল মানবীয় যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানসম্মত বিচার বুদ্ধির অনুসারী। আর এদের মূল উৎস হলো নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধি।

শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ফ্রিঙ্গার প্রিন্টের জনক বাংলাদেশী বিজ্ঞানী কাজি আজিজুল হক | Kazi Azizul hoq


কাজি আজিজুল হকের পারিবারিক নাম কাজি সৈয়দ আজিজুল হক। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭২ সালে। ব্রিটিশ ভারতের খুলনা জেলার ফুলতলার পয়োগ্রাম কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের ছাত্র ছিলেন।


আঙুল ছাপ আবিষ্কার

১৮৯২ সালে তিনি কাজ শুরু করেন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। তখন অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানবদেহের আকৃতি) পদ্ধতিতে অপরাধীদের শনাক্ত করার কাজ চলত। গণিতের ছাত্র এবং সদ্য সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পাওয়া আজিজুল হক অক্লান্ত চেষ্টার ফলে তিনি যে পদ্ধতি উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করলেন, তা-ই ‘হেনরি সিস্টেম’ বা ‘হেনরি পদ্ধতি’ নামে পরিচিত হলো] কাজের পুরস্কার হিসেবে আজিজুল হককে দেওয়া হয়েছিল ‘খান বাহাদুর উপাধি’, পাঁচ হাজার টাকা এবং ছোটখাটো একটা জায়গির। চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন পুলিশের এসপি।


মৃত্যু

অবিভক্ত ভারতের চম্পারানে (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের একটি জেলা যা উত্তর চম্পারান নামে পরিচিত) কাটে তার জীবনের শেষ দিনগুলো।[১] সেখানেই তিনি ১৯৩৫ সালে মারা যান। বিহারের মতিহারি স্টেশনের অনতিদূরে তার নিজের বাড়ি ‘আজিজ মঞ্জিল’-এর সীমানার মধ্যে তাকে সমাহিত করা হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর তার পরিবারের অন্য সদস্যরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে চলে আসেন। মরহুম আজিজুল হকের পুত্র আসিরুল হক পুলিশ বিভাগের ডিএসপি হয়েছিলেন। তার দুই বিখ্যাত নাতি ও নাতনি হচ্ছেন যথাক্রমে ইতিহাসের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ (১৯২২-২০১৪) এবং শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী (১৯৩৮-২০২১)।


মৌলিক গবেষণা

২০০১ সালে প্রকাশিত কলিন বিভান তার ফিঙ্গারপ্রিন্টস গ্রন্থে তার গবেষণার মৌলিকত্ব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানাচ্ছেন, অ্যানথ্রোপমেট্রিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আজিজুল হক ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হন। ফলে নিজেই হাতের ছাপ তথা ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাসকরণের একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। তিনি উদ্ভাবন করেন একটা গাণিতিক ফর্মুলা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ৩২টি থাক বানান। সেই থাকের ৩২টি সারিতে সৃষ্টি করেন এক হাজার ২৪টি খোপ। বিভান আরও জানাচ্ছেন, ১৮৯৭ সাল নাগাদ হক তার কর্মস্থলে সাত হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশাল এক সংগ্রহ গড়ে তোলেন। তার সহজ-সরল এই পদ্ধতি ফিঙ্গারপ্রিন্টের সংখ্যায় তা লাখ লাখ হলেও শ্রেণীবিন্যাস করার কাজ সহজ করে দেয়।


ব্রিটেনের ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি’ ফেন্সির উদ্যোগে চালু করেছে ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি আজিজুল হক অ্যান্ড হেমচন্দ্র বোস প্রাইজ’। যাঁরা ফরেনসিক সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সবিশেষ অবদান রাখবেন, এ পুরস্কার দেওয়া হবে তাদেরই।

রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

হিশাম বিন আব্দুর রহমান আদ দাখিল | Hisam-Bin-Abdur-Rahman-ad-dakil


Hisam-Bin-Abdur-Rahman-ad-dakil

ইতিহাস একটি জাতির কেবল উন্নতি ও উত্তরণের সোপান-ই নয়: ইতিহাস জাতিগত অবখয় হতে নিষ্কৃতির হাতিয়ার ও বটে। কিন্তু আজ আমরা ইতিহাস বিমুখী। জানিনা আমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিগাঁথা গৌরবময় ইতিহাস। আমরা পড়ি সূর্যসেনের বীরত্বের ইতিহাস ; জানিনা কে তিতুমীর? আমরা মন্ত্রমুগ্ধ চে গুয়েভারা-য়; কিন্তু নাম শুনিনি আবু বকর বিন ওমর লামতুনির। আছে আরো কত শত উদাহরণ।

তাই এবার আলোচনা করবো একজন মহান ব্যক্তির জীবনী নিয়ে। যিনি আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

.

চলুন শুরু করা যাক....

.

হিশাম বিন আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ.। ১৩৮ হিজরী (৭৫৫ খৃস্টাব্দ) তে পিতা আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ. এর হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া 'স্বাধীন উমাইয়া প্রশাসন'র দ্বিতীয় আমীর। অবশ্য ১৩৮-৩১৬ হি. (৭৫৫-৯২৮খৃস্টাব্দ) ব্যাপ্তিকাল দীর্ঘ শাসনব্যবস্থার শেষ দিক অর্থাৎ ৩০০-৩১৬হি.(৯১৩-৯২৮খৃ.) পর্যন্ত সময়কালকে স্বাধীন উমাইয়া খেলাফতের যুগ বলা হয়। ১৭২ হিজরীর জুমাদাল উলা (৭৮৮ খৃস্টাব্দর অক্টোবরে) কর্ডোভায় পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মেরিডায় অবস্থান করছিলেন। বড় ছেলে সুলাইমানের পরিবর্তে স্থালাভিষিক্তের উপযুক্ততায় যোগ্য বিবেচিত ছোট ছেলে হিশাম  পূর্ব ঘোষিত যুবরাজ হিসেবে পিতার মৃত্যুর ছয় দিন পর কর্ডোভায় এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ. এর এই নির্বাচন যে সঠিক ও দূরদর্শী ছিল তার প্রমাণ হলো: জনগণ হিশামকে ইলম,আমল ও তাক্বওয়ার ক্ষেত্রে মহান খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয রহ. এর সাথে তুলনা করতো।

.

হিশামের দায়িত্ব গ্রহণের সংবাদ প্রাপ্তির পর টলেডোয় অবস্থানরত বড় ভাই সুলাইমান অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন। বাধ্য হয়ে হিশাম সসৈন্যে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে যান এবং জাইয়ান নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধের পর পরাজিত হয়ে সুলাইমান টলেডোয় ফিরে যায়।

.

হিশামের আরেক ভাই ছিল আব্দুল্লাহ। ভাই হিশাম  থেকে যথেষ্ট সদাচরণ পাওয়ার পরও অকৃতজ্ঞ আব্দুল্লাহ পালিয়ে সুলাইমানের কাছে চলে যায়। এটা জানতে পেরে হিশাম আব্দুল্লাহ কে ফিরিয়ে আনতে দূত পাঠালে দূত তার সাথে সাক্ষাত করতে ব্যর্থ হন। রাস্ট্রের ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিবেচনায় বাধ্য হয়ে হিশাম টলেডো আক্রমণ করতে রওনা দেন। সুযোগ বুঝে কোপ মারতে চেয়েছিলেন ভাই সুলাইমান। হিশামের অনুপস্থিতিতে কর্ডোভা দখল করতে চাইলে জনগণ তাকে কঠোর হস্তে দমন করে। কর্ডোভা দখল করতে ব্যর্থ সুলাইমান এবার নিকটবর্তী শহর মেরিডা দখল করতে চাইল। কিন্তু সেখানে ও মেরিডা গভর্নর কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হয়। মেরিডা দখল করতে ব্যর্থ হয়ে সে মুরসিয়া যায়। সংবাদ পেয়ে হিশাম তাকে মুরসিয়া থেকে ভ্যালিন্সিয়া পর্যন্ত তাড়া করে। পরিশেষে কোন উপায় না দেখে ব্যর্থ সুলাইমান হিশামের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করলে হিশাম তাকে ও পূর্বে নিরাপত্তা দেওয়া আব্দুল্লাহকে উত্তর আফ্রিকায় চলে যাওয়ার সুযোগ দেন।

.

হিশাম বহুবার পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন। হিশাম বিন আব্দুর রহমান রহ. অত্যন্ত জ্ঞানানুরাগী মানুষ ছিলেন। আলেম সমাজ ও তাদের সাহচর্যকে পছন্দ করতেন। আরবি ভাষার প্রতি গুরুত্ব ও প্রচার প্রসারে তার অনন্য ভূমিকার ফলাফল হলো: তার সময়ে আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ইহুদি   খ্রিস্টানদের শিক্ষালয়েও আরবি ভাষা পাঠদান দেওয়া হত।

.

তাঁর সময়ে মৌলিক পরিবর্তন গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মালেকী মাযহাবের প্রচলন। এর আগে আন্দালুসে ইমাম আওযায়ী রহ. এর মাযহাবের প্রচলন ছিল। 

তাঁর আমলের বিখ্যাত আলেম দের একজন হলেন সা'সাআ বিন সালামা আশ শামী রহ.। যিনি তাঁর পিতার যুগে এবং তার যুগের প্রথম দিকে আন্দালুসের প্রধান মুফতি ও কর্ডোভা মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর যুগে অন্য আরেকজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন আব্দুর রহমান বিন মূসা রহ। উভয়েই হিশামের যুগে ইন্তেকাল করেন।

.

হিশাম বিন আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ. এর ৭ বছর ৯ মাস স্থায়ী সফল শাসন ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮০ হিজরীর সফর মাসে। (৭৯৬ খৃস্টাব্দ) মৃত্যু কালে তার বয়স ছিল ৩৯ বছর ৪ মাস ৪ দিন। পুত্র হাকাম তার জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। রাজপ্রাসাদেই তাঁকে দাফন করা হয়।

.

তথ্য সংগ্রহ: আন্দালুসের ইতিহাস (ডঃ রাগিব সারজানি)

সংক্ষিপ্ত করণ: ইবনে রফিক

মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০২২

আল-জাহরাভি : Al-Zahrawi


কর্ডোভার সোনালি যুগের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসাবিদ আবুল কাসিম আল-জাহরাভি, যিনি পৃথিবীকে উপহার দেন তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আত-তাসরিফ’। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে, আল-জাহরাভি স্পেনের আরব চিকিৎসাবিদদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শল্যবিদ ছিলেন। ইউরোপে তিনি আল-বুকাসিস (Albucasis), বুকাসিস (Bucasis) ও আল-য়্যারভিয়াস (Alyaharvious) নামে পরিচিত।


পুরোনাম:

আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আল-আব্বাস আল-জাহরাবি ।

জন্ম:

৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসিয়ার আজ-জাহরা শহরে আল-আনসারি গোত্রে তাঁর জন্ম। এই শরহটি কর্ডোবা থেকে 8 কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম  অবস্থিত।

শৈশব ও শিক্ষাদীক্ষা:

তার শৈশব এবং শিক্ষা সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমাদের হাতে নেই। যত দূর জানা যায়, জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি স্পেনের কর্ডোভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। খুব সম্ভবত মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে তিনি এল-জাহরা শহরে স্থানান্তরিত হন এবং বাকি জীবনটা সেখানেই কাটান।

ইতিহাসবিদগণের মতে, তিনি তার আত্মজীবনী লিখে গিয়েছিলেন। তাছাড়া, তিনি জীবিত থাকা অবস্থায়ই তাকে নিয়ে আরো অনেক লেখা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, ক্যাস্টিলিয়ান ও আন্দালুসিয়ানদের মধ্যকার যুদ্ধে এল-জাহরা শহর ধ্বংস হয়ে যায়। সাথে তার ব্যক্তিগত তথ্যাদি পাবার রাস্তাও চিরতরে বন্ধ হয়।

বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবন:

তিনি কর্ডোবায় তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। শিক্ষা শেষে তিনি জাহরায় চিকিৎসাসেবা শুরু করেন।শল্যচিকিৎসায় প্রথম থেকেই তিনি আশ্চর্যজনক সফলতা লাভ করেন। ফলে দ্রুত সবদিকে তার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সফলতার স্বাক্ষর হিসেবে খলিফা আবদুর রহমান ও খলিফা আবুল হাকাম – উভয়েরই চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। কর্ডোভার বিখ্যাত হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক হিসেবেও নিয়োগ পান তিনি।আর এখানে থাকাকালীনই তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কিতাব আল তাশরিফ’ রচনার কাজ শেষ করেন। এই গ্রন্থ বদলে দিয়েছিল মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা। সে সময়কার মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জন্য তার ত্রিশ খণ্ডের এই বিশ্বকোষটি ছিল অক্সিজেনস্বরূপ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথ্যালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা- সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল আল তাশরিফের ত্রিশ খণ্ডে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই মহাগ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন আল জাহরাউয়ি। সে বছরই খলিফার সহায়তায় বইটি প্রকাশিত হয়। তার ভুবনবিখ্যাত চিকিৎসাগ্রন্থ ‘আত-তাসরিফ’র মতো বিষয়বস্তু ও তত্ত্বনির্ভর এতো চমৎকার গ্রন্থ তৎকালীন যুগে আর কেউ লিখেন নি।

শল্যচিকিৎসা বিভাগের প্রভূত সংস্কার ও উন্নতি সাধন করেন তিনি।তিনি নিজেও মূলত একজন শল্যচিকিৎসকই ছিলেন। নিজের প্রিয় অধ্যায়কে সবার শেষ সংযোজন করা নিয়ে তার একটি বিখ্যাত মন্তব্য রয়েছে।

“চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে শল্যচিকিৎসা। একজন চিকিৎসক যতদিন না চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্য সকল শাখার সাথে যথার্থভাবে পরিচিত হয়ে উঠবেন, ততদিন তার শল্যচিকিৎসার দিকে যাওয়া উচিত নয়।”

শেষ জীবনে আবুল কাসিম সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। জীবনসায়াহ্নে তিনি চিকিৎসাগ্রন্থ প্রণয়নে মনোনিবেশ করেন। ব্যক্তিজীবনে জাহরাভি ছিলেন সাদাসিধে ও ‘অল্পে তুষ্টি’ প্রকৃতির। চিকিৎসাবিদ্যা ও ঔষধ তৈরি ইত্যাদির প্রতি ভীষণ ঐকান্তিক ছিলেন। গরিব-দুঃখী ও অসুস্থদের সেবায় নিজের অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন।

আল-জাহরাভির রচনা-সম্ভার:

পদার্থ, রসায়ন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর আল-জাহরাভি বিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থগুলোই তাকে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের মর্যাদা দেয়। চিকিৎসাবিষয়ক যে গ্রন্থটি তাকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি হলো “কিতাবুত তাসরিফ লিমান আজিযা আনিত তা’লিফ”। এই গ্রন্থটি ৩০টি অধ্যায়ে শিক্ষাগত (Educational) ও কার্যকরী (Effective) বিস্তৃত, যার প্রথম খণ্ডে এনাটমি (Anatomy), ফিজিওলজি (physiology) ও ডায়াবেটিকস (Dietetics) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে বিশেষত সার্জারি (Surgery) সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটিকে অধ্যাপক সারটন ‘Medical Encyclopedia’ নামে অভিহিত করেছেন। এর চিকিৎসার অংশের চেয়ে সার্জারীর অংশ সর্বদিক দিয়ে উন্নত ও মৌলিকতার পরিচায়ক হলেও চিকিৎসার অংশেও মৌলিকতার অভাব নেই। ঔষধ তৈরি করতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুসরণে পতন (Distillation) ও ঊর্ধ্বপাতন (sublimation) প্রথা প্রয়োগ করেছেন। এসব দিক বিবেচনায় গ্রন্থটিকে অভিনব বলা চলে। এছাড়াও গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ডে বা কার্যকরী-সার্জারি অংশে রয়েছে অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্যবলী।তার এই গ্রন্থ, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে ইউরোপের সকল বিখ্যাত মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় ৫ শতাধিক বছর প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

“যে ব্যক্তি শল্যচিকিৎসাকে জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করতে চান, তাকে অবশ্যই অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে।”- আল জাহরাউয়ি

তা কিছুতে প্রথম জাহরাভি:

ঐতিহাসিকদের মতে জাহরাভিই সর্বপ্রথম চিকিৎসক, যিনি ইউরোপে বৈজ্ঞানিক প্রথায় সার্জারির প্রচলন ও এর বিশদ বিবরণ প্রচার করেন। সার্জারি খণ্ডের বিশেষত্ব হলো- এর মধ্যে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনা করা হয়নি, ফলে এটা এমনিতেই পরিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ খন্ডটি পৃথকভাবে চিত্রাদিসহ প্রকাশিত হয়। ডা. ক্যাম্পবেলের মতে, “এ হলো এ বিষয়ের সর্বপ্রথম স্বাধীন সচিত্রগ্রন্থ”।

সার্জারির ক্ষেত্রে এই মহান মনীষীর অপরিসীম ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাফল্য হলেও মেডিসিন বা ঔষধ বিষয়েও যথেষ্ট অবদান পাওয়া যায়। তিনি কুষ্ঠরোগ ও এর প্রতিকার সম্বন্ধে তাঁর গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। তিনি অবস্থা বুঝে এ রোগের চিকিৎসা করতেন। তিনি ই সর্বপ্রথম এ রোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেন।

জাহরাভি শিশু রোগের চিকিৎসাতেও কিছু কিছু অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোসেফালিক সমস্যার সমাধান করার কৃতিত্ব দেয়া হয় জাহরাউয়িকে। মানুষের মাথার ক্রেনিয়াল ক্যাভিটি থেকে ‘সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড’ বা সিএসএফ নামক একপ্রকার তরল নির্গত হয়, যা মস্তিষ্ককে ঘিরে রাখে। হাইড্রোসেফালিক সমস্যা তখন হয়, যখন এই সিএসএফ তরল মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে এটি খুলির মধ্যে জমা হতে থাকে এবং শিশুদের মাথার আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। কেননা শিশুদের খুলির অস্থিগুলো পরিপক্ক এবং একীভূত নয়। অন্যদিক প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার আকৃতি বাড়তে পারে না এবং প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এই সমস্যাকে অনেক সময় ‘মাথায় পানি জমা’ও বলা হয়।

জাহরাউয়ি তার গ্রন্থে এই সমস্যার অস্ত্রোপচারের কথা সবিস্তারে লিখেছেন।

“নবজাতক শিশুর মাথার খুলি এমনিতেই নানাবিধ তরলে পূর্ণ থাকে। মাথায় পানি জমতে থাকলে প্রতিদিন তার মাথার আয়তন বাড়তে থাকে। ফলে খুলির অস্থিগুলো একীভূত হতে পারে না। এ সমস্যার সমাধানকল্পে, খুলির মধ্যভাগে তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে কেটে উন্মুক্ত করতে হবে। জমে থাকা তরল নির্গত হয়ে গেলে ক্ষত সেলাই করে শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে, যেন খুলির অস্থিগুলো একীভূত হতে পারে।”- আল তাশরিফ; ৩০তম খণ্ড

তিনি শিশু রোগের চিকিৎসার জন্য মাতৃস্তন থেকে দূষিত দুধ চুষে বের করার পরিবর্তে এর জন্য এক প্রকার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। শিশুদের রিকেটস হবার কারণ এবং এর প্রতিকারেরও এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি শিশুদের মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়ার কারণ সম্বন্ধে পূর্বেকার সব মতের ওপর নতুন মত প্রকাশ করেন।

চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম এক্টোপিক গর্ভধারণ নিয়ে বর্ণনা করেছেন। হায়মোফিলিয়াকে তিনি সর্বপ্রথম বংশগত বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন।

জিরাল্ড কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ:

‘আত-তাসরিফ’ গ্রন্থের সার্জারী খণ্ডটি জিরাল্ড ল্যাটিন ভাষায় মূল আরবিসহ প্রকাশ করেন। ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে গ্রন্থটির নাম দেয়া হয় ‘De Chirurgia’। এটি সালার্নো ও মন্টেপেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এ গ্রন্থ ২০০ প্রকার সার্জারির যন্ত্রপাতির নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গ্রন্থটি ইউরোপে কি পরিমাণ মর্যাদা লাভ করেছে, তা এর বারবার অনুবাদ থেকেই বোঝা যায়। ডা. ক্যাম্পবেলের মতে, গ্রন্থটি পরপর পাঁচবার ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। আর একথা সর্বসম্মত যে, তার এ গ্রন্থের প্রভাবেই ইউরোপে সার্জারির মান বিশেষভাবে উন্নীত হয়।

আল-জাহরাভির চিকিৎসাগ্রন্থের যে কয়েকটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, তন্মধ্যে দুইটি রয়েছে অক্সফোর্ডের বডলিয়েন (Bodleian) লাইব্রেরিতে এবং অন্য একটি রয়েছে গোথাতে। জিরাল্ডের ল্যাটিন অনুবাদের একটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে প্যারিসে। এতে তিনি গ্রন্থকারের নাম দিয়েছেন Abul Casim। কিছু পাণ্ডুলিপি ফ্লোরেন্স, ব্যামবার্গ, ফ্রাঙ্কয়েস, মন্টেপেলিয়ার, লিডেন ও ডেনিস রক্ষণাগারে সুরক্ষিত আছে।

ইউরোপিয়ানদের মূল্যয়ান:

“আবুলকাসিসের চিকিৎসাপদ্ধতি এতটাই উন্নত ছিল যে সেগুলোর কাছে গ্যালেনের চিকিৎসাপদ্ধতিও হয়ে যায়! ইউরোপীয়রা অন্ধের মতো অনুকরণ করতে শুরু করে তাকে। তার দেখানো পথে চলেই ইউরোপে শল্যচিকিৎসা আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে!” – চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ

ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল

তথ্য সুত্র:
1. আকবর আলী, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, পৃষ্ঠা: ৩৩৯)
2. al-Zahrāwī, Abū al-Qāsim Khalaf ibn ʻAbbās (১৯৭৩)। مقالة في العمل باليد: A Definitive Edition of the Arabic
3. ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোর্স
4. উইকিপিডিয়া

লিখেছেন— Raqib Hussain

রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০২২

বদর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল : Bodorer juddho : Bodor war

২য় হিজরীর ১৭ রামাদান সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ।

সত্য আর মিথ্যার মাঝে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার দিন। আল ইয়াওমাল ফুরক্বান!

আল্লাহুম্মানসুরনা ‘আলাল ক্বাওমিল কাফিরীন!

1. হক্কের পক্ষে মাত্র ৩১৩জন vs বাতিলের পক্ষে ১০০০।
2. বদর প্রান্তরে মালাইকাদের অবতরণ ।
3. সাহাবাদের চোখে কাফিরদের সংখ্যা কম করে দেখানো।
4. শাইত্বনদের আতংকিতবস্থায় পলায়ন।
5. মুসলিমদের/ইসলামের একতরফা বিজয়।
6. সংখ্যা কখনো হক্ব প্রতিষ্ঠার মানদন্ড নয়।

বদর যুদ্ধের কারণসমূহ:

মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা; আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ষড়যন্ত্র, মদিনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, আর্থিক কারণ, নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, আবু সুফিয়ানের কাফেলা আক্রমণের মিথ্যা গুজব।

দ্বিতীয় হিজরী সালে নাবী (ﷺ) এর কাছে এই মর্মে খবর পৌঁছল যে, কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া হতে মক্কার পথে অগ্রসর হচ্ছে। কাফেলার নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। নাবী (ﷺ) কাফেলাটির পিছু ধাওয়া করার আহবান জানালেন। তবে এর জন্য বেশী প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন নি। দ্রুত বের হওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে এর জন্য বেশী সময় পান নি। তাই তিনি তিনশত তের জন সাহাবী নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। তাদের কাছে ছিল দুইটি ঘোড়া এবং সত্তরটি উট। লোকেরা পালাক্রমে আরোহন করতেন।

ঐ দিকে আক্রমণের আশঙ্কায় কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান যাত্রাপথে সাক্ষাত লাভ করা বিভিন্ন কাফেলাগুলির কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলেন। ফলে তিনি মুসলিমদের আক্রমণের খবর পান। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠানো হয়। সে দ্রুত মক্কা পৌছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী উটের নাক চাপড়ায়, আসন উল্টিয়ে দেয়, নিজের জামা ছিড়ে ফেলে এবং উটে বসে ঘোষণা করে যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে পারে।

"কুরাইশগণ, কাফেলা আক্রান্ত, কাফেলা আক্রান্ত। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের সম্পদ রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীরা এগিয়ে আসছে। তাই আমার মনে হয় না যে তোমরা তা পাবে। তাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো ”

—মক্কায় পৌছানোর পর জমজম ইবনে আমর গিফারির আহ্বান.

এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন শুরু হয়। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম‌ ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত।

আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়।উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের বের হওয়ার অবস্থা বর্ণনা করে বলেন-

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

‘‘আর তাদের মত হয়ে যেয়োনা, যারা বের হয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোকদেরকে দেখাবার উদ্দেশ্যে। আর আল্লাহর পথে তারা বাধা দান করত। বস্ত্ততঃ আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে সে সমস্ত বিষয় যা তারা করে’’। (সূরা আনফাল-৮:৪৭) সুতরাং পূর্ব প্রস্ত্ততি ছাড়াই আল্লাহ্ তা‘আলা উভয় দলকে মুখোমুখী করে দিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ‘‘এমতাবস্থায় যদি তোমরা পারস্পরিক অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে, তবে তোমরা মতবিরোধে লিপ্ত হতে’’। (সূরা আনফাল-৮: ৪২)

যাই হোক নাবী (ﷺ) যখন কুরাইশদের বের হওয়ার কথা জানতে পারলেন, তখন সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন।

সেই পরামর্শ সভায় মুহাজিরগণ প্রথমে কথা বললেন এবং অত্যন্ত সুন্দর পরামর্শ দিলেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয়বার পরামর্শ চাইলেন। এবারও মুহাজিরগণই কথা বললেন। তৃতীয়বার পরামর্শ চাইলেন। এতে আনসারগণ বুঝতে পারলেন যে, নাবী (ﷺ) তাদেরকে উদ্দেশ্য করছেন এবার তাদের পরামর্শ শুনতে চাচ্ছেন। তাই সা’দ বিন মুআয উঠে দাঁড়ালেন এবং আনসারদের পক্ষ হতে তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কথাগুলো বললেন। তিনি তাতে রসূল (ﷺ) কে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, আনসারগণ যুদ্ধ করার জন্য পূর্ণ প্রস্ত্তত রয়েছেন। সা’দ বিন মুআয বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনি সম্ভবত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। আপনি যদি আমাদেরকে ঘোড়া ছুটিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাহলে আমরা তাই করব। আপনি আমাদেরকে যেখানে যেতে বলেন, আমরা সেখানেই যাবো। এমন কি বারাকুল গামাদ (লোহিত সাগরের অপর প্রামেত্মর একটি অঞ্চলের নাম) পর্যন্ত যেতে বলেন, তাহলে আমরা সেখানে যেতেও দ্বিধাবোধ করবনা। মিকদাদ বিন আসওয়াদও অনুরূপ কথা বললেন- মিকদাদ (রাঃ) বললেন- মুসা (আঃ) এর অনুসারীরা যেরূপ বলেছিল আমরা সেরূপ বলবনা। তারা মুসাকে বলেছিল- আপনি এবং আপনার প্রভু তাদের (শত্রুদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব। আর আমরা বলছিঃ আমরা আপনার ডানে, বামে সামনে এবং পিছনে তথা চতুর্দিক থেকেই যুদ্ধ করব। সাহাবীদের কথা শুনে বিশেষ করে এই দুই নেতার কথা শুনে নাবী (ﷺ) খুব খুশী হলেন। তিনি বললেন- তাহলে তোমরা আগে বাড়, সামনে চল এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ্ আমাকে কাফেরদের দুই দলের একটির উপর বিজয় দান করার ওয়াদা করেছেন। আর আমি কাফের নেতাদের নিহত হওয়ার স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি।

এরপর নাবী (ﷺ) সামনে চলতে লাগলেন এবং বদর প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি যখন মুশরিকদের মুখোমুখী হলেন এবং উভয় দল পরস্পরকে দেখতে পেল, তখন রসূল (ﷺ) আল্লাহর দরবারে উভয় হাত তুলে দু’আ করতে লাগলেন এবং তাঁর প্রভুর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। মুসলমানেরাও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলেন এবং আল্লাহর মদদ চাইলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা এ সময় কুরআনের এই আয়াত নাযিল করলেন-

إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ

‘‘তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করছিলে স্বীয় প্রভুর নিকট, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদের মঞ্জুরী দান করলেন যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব ধারাবাহিকভাবে আগত এক হাজার ফিরিস্তার মাধ্যমে’’। (সূরা আনফাল-৯)

কাফের বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় বেশি হলেও বিজয়লাভের প্রধান উপকরণ ছিল ইমানের বল; অস্ত্রবল ও সংখ্যা নয়।

নবী করিম (সা.) মুসলমানদের জিহাদ সম্বন্ধে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করলেন। যুদ্ধে জয়লাভ করা সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামাদির আধিক্যের ওপর নির্ভর করে না; বরং মহাপরীক্ষার সময় আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে ধৈর্য অবলম্বন করা এবং অটল থাকাই জয়লাভের উপায়—এ কথাগুলো তিনি উত্তমরূপে সাহাবিদের হৃদয়ঙ্গম করিয়ে দিলেন।
তিনি বদর প্রান্তরে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন, তাঁর দোয়া কবুল করে আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধে ফেরেশতা দিয়ে মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে, “এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সহায়তা করবেন?” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং সাবধান হয়ে চলো, তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৪-১২৫)
আরবের তৎকালীন প্রথাগত যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রথমে সংঘটিত মল্লযুদ্ধে মুসলিম বীরযোদ্ধাদের হাতে কাফের বাহিনী পরাজিত হয়। এরপর হক ও বাতিলের, নূর ও জুলুমাতের, ইসলাম ও কুফুরের উভয় বাহিনী পরস্পর সম্মুখীন। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বীরবিক্রমে লড়াই করে ইসলামের বিজয় কেতন ছিনিয়ে আনেন। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় যুদ্ধ করবে, শহীদ হবে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (বায়হাকি) এমন আশ্বাসবাণী পেয়ে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান জানবাজি রেখে কাফেরদের মোকাবিলায় জয়লাভ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে ৭০ জন কাফের নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। অন্যদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম বীর সেনা শহীদ হন; কাফেরদের বহু অস্ত্র ও রসদপত্র মুসলমানদের হস্তগত হলো।


দেশের সার্বভৌমত্ব অর্জন ও স্বদেশ রক্ষায় জীবনদানকে মহানবী (সা.) শাহাদতের সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে শহীদদের মর্যাদা ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের কখনোই মৃত মনে কোরো না, বরং তারা জীবিত ও তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে জীবিকাপ্রাপ্ত।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯) আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য ও মাতৃভূমি সুরক্ষার জন্য যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন, তাঁদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয়, তাদের মৃত বোলো না, তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৪) বদরের যুদ্ধে নিহত শহীদদের সম্পর্কে লোকেরা যখন বলাবলি করছিল যে ‘অমুকের ইন্তেকাল হয়েছে, সে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে’ তখন তাদের মন্তব্যের জবাবে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।


১৭ রমজান বদর যুদ্ধ থেকেই আরম্ভ হয় ইসলামের মহাজয় যাত্রা। তওহিদ ও ইমান যে এক অজেয় শক্তি, এর সামনে যে দুনিয়ার সব শক্তিই মাথা নত করতে বাধ্য, এ কথা মুসলমানরা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন। সত্যাসত্যের পার্থক্য দিবা ভাস্করসম উজ্জ্বলরূপে মানব হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বস্তুত, বদর যুদ্ধ ছিল ইমানের মহাপরীক্ষা। এতে রোজাদার সাহাবিরা যেভাবে কৃতিত্বের সঙ্গে সফলকাম হতে সক্ষম হয়েছেন, জগতের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সাফল্যের অপূর্ব বিজয়গাথা ইসলামের ত্যাগের শিক্ষায় সত্য ও ন্যায়ের পথে মুসলমানদের যুগ যুগ ধরে প্রাণশক্তি জুগিয়ে আসছে।