ইতিহাস একটি জাতির কেবল উন্নতি ও উত্তরণের সোপান-ই নয়: ইতিহাস জাতিগত অবখয় হতে নিষ্কৃতির হাতিয়ার ও বটে। কিন্তু আজ আমরা ইতিহাস বিমুখী। জানিনা আমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিগাঁথা গৌরবময় ইতিহাস। আমরা পড়ি সূর্যসেনের বীরত্বের ইতিহাস ; জানিনা কে তিতুমীর? আমরা মন্ত্রমুগ্ধ চে গুয়েভারা-য়; কিন্তু নাম শুনিনি আবু বকর বিন ওমর লামতুনির। আছে আরো কত শত উদাহরণ।
তাই এবার আলোচনা করবো একজন মহান ব্যক্তির জীবনী নিয়ে। যিনি আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
.
চলুন শুরু করা যাক....
.
হিশাম বিন আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ.। ১৩৮ হিজরী (৭৫৫ খৃস্টাব্দ) তে পিতা আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ. এর হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া 'স্বাধীন উমাইয়া প্রশাসন'র দ্বিতীয় আমীর। অবশ্য ১৩৮-৩১৬ হি. (৭৫৫-৯২৮খৃস্টাব্দ) ব্যাপ্তিকাল দীর্ঘ শাসনব্যবস্থার শেষ দিক অর্থাৎ ৩০০-৩১৬হি.(৯১৩-৯২৮খৃ.) পর্যন্ত সময়কালকে স্বাধীন উমাইয়া খেলাফতের যুগ বলা হয়। ১৭২ হিজরীর জুমাদাল উলা (৭৮৮ খৃস্টাব্দর অক্টোবরে) কর্ডোভায় পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মেরিডায় অবস্থান করছিলেন। বড় ছেলে সুলাইমানের পরিবর্তে স্থালাভিষিক্তের উপযুক্ততায় যোগ্য বিবেচিত ছোট ছেলে হিশাম পূর্ব ঘোষিত যুবরাজ হিসেবে পিতার মৃত্যুর ছয় দিন পর কর্ডোভায় এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ. এর এই নির্বাচন যে সঠিক ও দূরদর্শী ছিল তার প্রমাণ হলো: জনগণ হিশামকে ইলম,আমল ও তাক্বওয়ার ক্ষেত্রে মহান খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীয রহ. এর সাথে তুলনা করতো।
.
হিশামের দায়িত্ব গ্রহণের সংবাদ প্রাপ্তির পর টলেডোয় অবস্থানরত বড় ভাই সুলাইমান অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন। বাধ্য হয়ে হিশাম সসৈন্যে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে যান এবং জাইয়ান নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধের পর পরাজিত হয়ে সুলাইমান টলেডোয় ফিরে যায়।
.
হিশামের আরেক ভাই ছিল আব্দুল্লাহ। ভাই হিশাম থেকে যথেষ্ট সদাচরণ পাওয়ার পরও অকৃতজ্ঞ আব্দুল্লাহ পালিয়ে সুলাইমানের কাছে চলে যায়। এটা জানতে পেরে হিশাম আব্দুল্লাহ কে ফিরিয়ে আনতে দূত পাঠালে দূত তার সাথে সাক্ষাত করতে ব্যর্থ হন। রাস্ট্রের ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিবেচনায় বাধ্য হয়ে হিশাম টলেডো আক্রমণ করতে রওনা দেন। সুযোগ বুঝে কোপ মারতে চেয়েছিলেন ভাই সুলাইমান। হিশামের অনুপস্থিতিতে কর্ডোভা দখল করতে চাইলে জনগণ তাকে কঠোর হস্তে দমন করে। কর্ডোভা দখল করতে ব্যর্থ সুলাইমান এবার নিকটবর্তী শহর মেরিডা দখল করতে চাইল। কিন্তু সেখানে ও মেরিডা গভর্নর কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হয়। মেরিডা দখল করতে ব্যর্থ হয়ে সে মুরসিয়া যায়। সংবাদ পেয়ে হিশাম তাকে মুরসিয়া থেকে ভ্যালিন্সিয়া পর্যন্ত তাড়া করে। পরিশেষে কোন উপায় না দেখে ব্যর্থ সুলাইমান হিশামের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করলে হিশাম তাকে ও পূর্বে নিরাপত্তা দেওয়া আব্দুল্লাহকে উত্তর আফ্রিকায় চলে যাওয়ার সুযোগ দেন।
.
হিশাম বহুবার পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন। হিশাম বিন আব্দুর রহমান রহ. অত্যন্ত জ্ঞানানুরাগী মানুষ ছিলেন। আলেম সমাজ ও তাদের সাহচর্যকে পছন্দ করতেন। আরবি ভাষার প্রতি গুরুত্ব ও প্রচার প্রসারে তার অনন্য ভূমিকার ফলাফল হলো: তার সময়ে আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ইহুদি খ্রিস্টানদের শিক্ষালয়েও আরবি ভাষা পাঠদান দেওয়া হত।
.
তাঁর সময়ে মৌলিক পরিবর্তন গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মালেকী মাযহাবের প্রচলন। এর আগে আন্দালুসে ইমাম আওযায়ী রহ. এর মাযহাবের প্রচলন ছিল।
তাঁর আমলের বিখ্যাত আলেম দের একজন হলেন সা'সাআ বিন সালামা আশ শামী রহ.। যিনি তাঁর পিতার যুগে এবং তার যুগের প্রথম দিকে আন্দালুসের প্রধান মুফতি ও কর্ডোভা মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর যুগে অন্য আরেকজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন আব্দুর রহমান বিন মূসা রহ। উভয়েই হিশামের যুগে ইন্তেকাল করেন।
.
হিশাম বিন আব্দুর রহমান আদ দাখিল রহ. এর ৭ বছর ৯ মাস স্থায়ী সফল শাসন ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮০ হিজরীর সফর মাসে। (৭৯৬ খৃস্টাব্দ) মৃত্যু কালে তার বয়স ছিল ৩৯ বছর ৪ মাস ৪ দিন। পুত্র হাকাম তার জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। রাজপ্রাসাদেই তাঁকে দাফন করা হয়।
.
তথ্য সংগ্রহ: আন্দালুসের ইতিহাস (ডঃ রাগিব সারজানি)
সংক্ষিপ্ত করণ: ইবনে রফিক