১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন্য সৈন্য নিয়ে বাংলা জয়ে করেছিলেন বখতিয়ার খিলজি। হিন্দু এবং সেকুলাঙ্গার ঐতিহাসিকেরা বঙ্গবিজয়ী মহান মুজাহিদ ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজিকে বিতর্কিত করতে যে অপবাদগুলো দেয় সেই অভিযোগগুলো নিচে দেওয়া হলো। সাধারন মুসলমানরাও এদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হয়ে বঙ্গবিজয়ী এই মহান মুজাহিদ সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকেন।
এখন আসুন দেখা যাক এগুলোর সত্যতা কতটুকু..
১: নদীয়াতে গনহত্যা- ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত তৎকালীন নদিয়া ছিলো হিন্দুদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান। এখানে বসবাস ছিল হিন্দু এলিট শ্রেণীর, লক্ষ্মণসেন নিজের শেষ সময়টা কাটানোর জন্য এটি বেচে নেন।অধীবাসীদের বেশিরভাগই ছিলো ব্রাহ্মণ,এদের চরিত্র সম্বন্ধে বলার প্রয়োজন মনে করছিনা। খলজীর নদীয়া আক্রমণের প্রায় বছর দুয়েক আগেই এরা সুযোগ বুঝে পালাতে থাকে,কারণ খলজীর প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে এরা অবগত ছিল। খলজী নদীয়া আক্রমণ করেন পশ্চিম সীমান্তের ঝাড়খন্ডের দূর্গম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। তো ভাই, এই দূর্গম জঙ্গলের ভিতর খলজী গণহত্যা কার উপর চালিয়েছেন গাছের উপর.!! তিনি যখন মূল শহরে প্রবেশ করেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলো মাত্র ১৭ জন!যদিও ধরেনিই এই সতেরো জন সৈন্য নিয়েই তিনি গণহত্যা চালাচ্ছিলেন,তখন হিন্দু মহাবীরেরা কি করছিল! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যেমন তাদের কাছে নেই,তাদের দাবি করা অভিযোগগুলোর বিষয়েও তাদের কাছে কোন ঐতিহাসিক দলীল নেই। সত্য হলো বখতিয়ার কোন গনহত্যা চালান নি।
২: নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংশ- বিহারে অবস্থিত নালন্দা কিন্তু হিন্দুদের কোন মানমন্দির নয়,এটি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে বৌদ্ধদের দ্বারা,এটা পরিচালিতও হতো বৌদ্ধদের দ্বারা।
নালন্দা মোট তিনবার আক্রান্ত হয়—
• প্রথম আক্রমণের শিকার হয় প্রতিষ্ঠার একশত বছরের মধ্যে হুনদের দ্বারা।
• দ্বিতীয় আক্রমণের শিকার হয় হিন্দুদের মহারাজা শশাঙ্কের হাতে।
[ঐতিহাসিক ডিডি গোস্বামী এ সম্পর্কে বলেন,,সর্বপ্রথম এই মহাবিহারের উপর আক্রমণ আসে শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্তের দ্বারা। তার বৌদ্ধ বিদ্বেষ এতোটাই তীব্র ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে গাঙ্গেয় উপদ্বীপ দখল বৌদ্ধ অনুরুক্ত হর্ষবর্ধনকে হত্যার করার পর বোধিবৃক্ষকে উপড়ে নদীতে ফেলে দেন, বৌদ্ধের পদচিহ্ন ধ্বংস করেন। নালন্দার প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন তিনি,চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ্গের আগমনের সময়ও নালন্দা তার দৈন্যদশা থেকে বের হতে পারে নি।]
• তৃতীয় আক্রমণ হয় এক বহিঃশত্রু দ্বারা ১১৯৩ সালে, এই সময় নালন্দা পুরোপুরি ভস্মীভূত করা হয়। এই আক্রমণের সময়কাল নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এখন আসুন, খলজীর দিকে ফিরে যায়। হিন্দু রাজ ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের ভাষায়,খলজী হিন্দুস্থানে আসেন ১১৯৫ সালে,হুসাম উদ্দীনের কাছে কাজ পান ১১৯৬ সালে, উদন্তপুরী বিহার আক্রমণ করেন ১১৯৯ সালে,ইরফান হাবিবের ভাষ্যমতে ১১৯৯ সালে দক্ষিণ বিহারে অভিযান চালিয়ে খলজী গোবিন্দপালকে পরাজিত করেন। নালন্দা থেকে এর দূরত্ব প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার, তাবাকাতে নাসিরিতে যে টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণদের হত্যা এবং মন্দির ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে, এটি হচ্ছে মূলত বৌদ্ধদের এই উদন্তপুরী বিহার,খলজী দূর্গ ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে এটি আক্রমণ করেন,যা ছিল লক্ষণসেনেরই চাল।
যদুনাথ সরকারের মতে খলজীর বাংলা আক্রমণ ছিলো ১২০১ সালে। এখানে সবচেয়ে মজার বিষয়টি হচ্ছে সকল ঐতিহাসিকের দাবি অনুযায়ী খলজী বঙ্গবিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ ই মে।অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে নালন্দাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। যে লোকটি বাংলায় আসেন ১২০৪ সালে,সে কি করে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করলো তা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবে।১১৯৩ সালে নালন্দা যার হাতে ধ্বংস হয়েছিল তিনি হচ্ছেন তীরহুতের হিন্দুরাজা অর্জুন, যার দায় চাপানো হয় মহান মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির উপর। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতবাসী করুক।
৩. বিদেশী আক্রমণকারী- তুর্কিদের খলজী গোত্রের মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজিকে হিন্দু ঐতিহাসিকেরা প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করে। আসলেই কি খলজীই প্রথম বিদেশী, যিনি বাংলা আক্রমণ করেন!
উত্তর— এ দাবিটা সম্পূর্ণ ভুয়া। বৈদিক যুগের শেষদিকে হিন্দু আর্যরা প্রথম বাংলা আক্রমণ করেন,তবে তারা সফল না হলেও ব্রাক্ষণরা বাংলায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে, এবং বাংলার অধিবাসীদের উপর জাতপাত প্রথা চাপিয়ে দেন। এরপর বাংলা আক্রমণ করে অবাঙ্গালী গুপ্ত হিন্দুরা বৌদ্ধদের উপর নির্যাতনের ফলে একসময়ের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা হয়ে উঠে হিন্দুদের অভয়ারণ্য। হুনদের আক্রমণে গুপ্তদের যখন পতন ঘটে বাংলা দখল করেন কর্ণাট দেশ থেকে আগত হিন্দু সেনরা,বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার যথারীতি চলতে থাকে।
৫. ধর্মান্তরে বাধ্য করা- খলজিকে দেয়া আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি নাকি গণহারে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেন এবং যারা অস্বীকার করে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করেন। এই অভিযোগটিও সম্পূর্ণ ভূয়া। খলজীর আগমনের অনেক আগেই এদেশে সুফি-দরবেশদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন ঘটে।এসব সুফিদের মধ্যে অন্যতম পান্ডুয়ার সুফি শেখ তাবরীজি এবং তাঁর শিষ্যরা।তাদের আচরণে আকৃষ্ট হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু মুসলিম জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। সেইসময় মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমন থেকে বাঁচতে মধ্য এশিয়া থেকে অনেক সুফি বখতিয়ার খিলজির আমন্ত্রণে তার রাজ্যে আসেন। সেসব সুফিদের ধর্মপ্রচারের কারনে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে।
৬. বাংলা লুণ্ঠনের জন্য অভিযান- এই অভিযোগটি খোদ একশ্রেণির কথিত মুসলমানদের মধ্যেও দেখা যায়! তিনি বাংলা আক্রমণ করলেন কেন, এসবের কি দরকার ছিল?
উত্তর:- সেসব কুলাংগারদের জেনে রাখা উচিত।কেয়ামতের ময়দানে প্রত্যেক মুসলমানকেই তাঁর প্রতিবেশী অমুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, আশপাশের অমুসলিমদের সে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিল কিনা? তিনি যদি বাংলা আক্রমণ না করতেন আমরা এখনো কুফরীতেই লিপ্ত থাকতাম। নিজেরা নামে মুসলিম পরিচয়টাও দিতে পারতাম কিনা সন্দেহ!! তাঁর বাংলা আক্রমণের কারণ হিসেবে ধরতে গেলে প্রথমত স্থানীয় মুসলমানদের উপর হিন্দুদের অত্যাচার,এর পর আসে ইসলাম সম্পর্কে এই ভুখন্ডের অধীবাসীদের আগ্রহ। যদি তা না হতো তাঁর আক্রমণের সময় গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠতো,তা না হওয়ায় বুঝা যায় তারা এই অভিযানকে খুশিমনেই নিয়েছিলো। দ্বিতীয়ত হিন্দুদের হাতে নির্যাতিত বৌদ্ধদের আমন্ত্রণ। রাজ্যবিস্তার একজন বীরের সহজাত প্রবৃত্তি,আর খলজী ছিলেন একজন সেনানায়ক এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। রাষ্ট্রিয়ভাবে বাঙ্গালীদের উপর হিন্দুধর্ম চাপিয়ে দেয়া সম্রাট অশোক,নালন্দা ধ্বংসকারী শশাঙ্ক যদি হিন্দুদের কাছে বীর হয়,উন্নত চরিত্র দিয়ে ইসলাম প্রচারকারী মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি আমাদের কাছে হওয়া দরকার ছিলো মহাবীর।কিন্তু আফসোস, শতকরা ৯০% মুসলমান তাঁকে লুণ্ঠনকারী হিসেবেই চিনে।
কবি আল মাহমুদের ভাষায় বখতিয়ার খিলজি,
"আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি।
খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।"
(কবিতা- বখতিয়ারের ঘোড়া)