সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০২২

মুতার যুদ্ধের ঘটনা ও ফলাফল | Battle of Mu'tah


হুদাইবিয়া সন্ধি শেষ হলো। মক্কার কাফেরদের থেকে মুসলমানগণ এখন নিরাপদ। তাই রাসূলে কারীম  (ﷺ) পৃথিবীর শাসকবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াতী পত্র প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। পত্র পাঠালেন খসরু-হিরাকল, শুরাহবিল-আম্মারসহ আরো অনেকের নিকটই। কেউ ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলো,আবার কেউ কুফুরের অতল গহ্বরে ডুবে রইলো। শুরাহবিল ছিলো সে হতভাগাদের একজন।


রাসূলে কারীম (ﷺ) হারিছ ইবনে ওমায়ের (রাযি) কে বসরার গভর্নর শুরাহবিল ইবনে আমরের দরবারে পাঠান। সে ইবনে ওমায়ের (রাযি.) কে প্রথমে বাঁধার নির্দেশ দেয়, অতঃপর শহীদ করে।

এ সংবাদ রাসূলের নিকট পৌঁছলে তিনি ভীষণ মর্মাহত হলেন এবং একটি সৈন্যদল গঠন করেন। কারণ দূত হত্যা ছিলো সর্বযুগেই জঘন্য অপরাধ। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষ এমনই অন্ধ করে রেখেছিলো তাদেরকে যে,নীতি ও নৈতিকতা সবকিছু বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতো না তারা। রাসূলে কারীম (ﷺ)  হযরত যায়েদ (রাযি.) কে সেনাপতি ঘোষণা করে তিন হাজারের একটি বাহিনী গঠন করেন। আর ওছীয়ত করে দেন,‘ যদি যায়েদ শহীদ হয়, তাহলে জা’ফর বিন আবী তালিব সেনাপতি হবে,যদি সে শহীদ হয়, তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ঝাণ্ডা হাতে তোলে নিবে।

মুসলিমবাহিনী মদীনা থেকে যাত্রা করলেন। মা’আন নামক স্থানে যাত্রাবিরতি দিলেন। খবর পৌঁছলো, খোদ রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াস একলক্ষ্য সৈন্যবহর নিয়ে বালকা' নামক স্থানে অবস্থান করছে।[১] স্বভাবতই মুসলিম বাহিনীতে কিছুটা চিন্তা-ভাবনা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। নিজেদের শলা-পরামর্শে সাহাবায়ে কেরাম সিদ্ধান্ত নিলেন, রাসূল (ﷺ) কে এ সম্পর্কে অবগত করবেন এবং পরবর্তী সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবেন। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রাযি. দৃঢ়তার সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন,
‘‘হে রাসূলের সাহাবাগণ! কী হলো তোমাদের, শত্রুর সংখ্যাধিক্যে কেন তোমরা চিন্তিত? আমরা সংখ্যা-শক্তির ভিত্তিতে লড়াই করি না। মনে রেখো,বিজয়ের বেশে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা আসিনি। আমরা এসেছি শাহাদাতের আবে-হায়াতে ঠোঁট ভিজিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে। সুতরাং অগ্রসর হও,ঝাঁপিয়ে পড়ো এবং রক্তের দরিয়ায় সাঁতার দিয়ে জান্নাতের সবুজ বাগিচায় গিয়ে হাজির হও’’! 

সিপাহসালারের এ ভাষণ শুনে মুজাহিদদের হৃদয়ে যেন ঈমানের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো এবং শাহাদাতের তামান্নায় তাঁরা জিহাদের ময়দানে অগ্রসর হতে লাগলেন। বালকা’ সীমান্তে পৌঁছলে মুশারিফ নামক স্থানে রোমানদের মুখোমুখি হলেন, শত্রুরা অগ্রসর হলে তারা মূতা নামক গ্রামে সমবেত হোন,এখানেই সংঘটিত হয় ‘ঐতিহাসিক মূতার যুদ্ধ’! [২]

মূতার প্রাঙ্গণে সারিবদ্ধ দু’দল। হক-বাতিলের যুদ্ধ। ঈমান ও কুফুরের লড়াই, যা চলতে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। যু্দ্ধে রোমানদের সংখ্যা দেড় লাখ, বিপরীতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো মাত্র তিন হাজার! বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটা বাস্তব সত্য। যেন পিঁপড়ে-হাতির লড়াই!

তাকবীরের ধ্বনি তোলে সাহাবীগণ এগিয়ে গেলেন। হযরত যায়েদের হাতে রাসূলের প্রদত্ত সে হেলালী ঝাণ্ডা। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। পিঁপড়ে-হাতির লড়াই মনে হলেও বাস্তবে যেন বাঘ-সিংহের লড়াই! হযরত যায়েদ বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু একসময় বল্লমের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো গোটা দেহ। ঝাণ্ডা হাতে নিলেন হযরত জা’ফর বিন আবি তালিব রাযি.। যুদ্ধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তিনি অশ্বপিঠ থেকে নেমে পড়লেন এবং যুদ্ধ করতে থাকলেন। এমতাবস্থায় কাফেরের আঘাতে তার ডানহাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। তিনি বামহাতে ঝাণ্ডা নিলেন। কিন্তু এ হাতও কেটে ফেললো। অতঃপর তিনি উভয় বাহু দ্বারা ঝাণ্ডাটি ঝাঁপটে ধরলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে শহীদ হয়ে গেলেন। [৩]

জা’ফর রাযি. এর শাহাদাতের পর রাসূলের মনোনীত সর্বশেষ সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযি. ঝাণ্ডা হাতে নিলেন। অশ্বপিঠে চড়ে তিনি শত্রুদের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন।

অতঃপর ছাবিত ইবনে আরকাম রাযি. ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে জনতার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন,‘‘হে মুসলিম জনতা, তোমরা শলা-পরামর্শের মাধ্যমে একজনকে সেনাপতি নিযুক্ত করো! জবাবে তারা বললেন; আপনি তো আছেনই। তখন তিনি বললেন, না আমি এর যোগ্য নই’’। তখন সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ রাযি. সেনাপতি নিযুক্ত করেন।

প্রিয় নবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম বাহিনীর তিন সিপাহসালার একে একে শহীদ হয়েছেন। এখন মুহূর্তে ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিলেন মহাবীর হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ।
হযরত খালেদ রাযি. এর নেতৃত্বে আবারো শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। কটুকাটা হচ্ছিলো শত-সহস্র কাফের। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায় স্বয়ং হযরত খালেদ রাযি. এর থেকে। তিনি বলেন, ‘‘মূতার যু্দ্ধে আমার হাতে নয়টি তরবারী ভেঙ্গে ছিলো,শুধু মাত্র ছোট একটি ইয়ামানী তরবারী অবশিষ্ট ছিলো’’! সন্ধা হলে যু্দ্ধবিরতির ঘোষণা হলো। রাতের বেলা হযরত খালেদ রাযি. অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করলেন। সৈন্যদের তিনি নতুনভাবে ঢেলে সাজালেন। পিছনের সারির সৈন্যদের সামনে ও সামনের সারির সৈন্যদের পিছনে নিয়ে গেলেন এবং ডান সারির সৈন্যের বামে ও বাম সারির সৈন্যদের ডানে রদবদল করলেন। তাঁর এ কৌশল ছিলো অতি উচ্চ সামরিক দূরদর্শিতার পরিচয়!

পরদিন ভোরবেলা। সৈন্যদের তাকবীর-ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো গোটা রণাঙ্গন। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রােমান সেনারা। ভাবলো মদীনা থেকে তাজাদম সৈন্যের যোগান চলে এসেছে। কানাঘুষা শুরু হলো,‘ক্ষুদ্র এ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে যদি এতই নাজেহাল হতে হয়, নতুন সে বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের বিপদে ফেলা আহম্মকি ছাড়া কিছু নয়’!

আল্লাহ পাক কাফেরদের মনে ভীতি সঞ্চার করেছেন। এরপর তারা পিছু হটা শুরু করলো। মুজাহিদগণও তাদের ধাওয়া করাটা সমীচীন মনে করেননি। পরিশেষে তারাও মদীনায় ফিরে আসলেন।

আল্লাহ তা'আলা মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। এ বিজয়ের ফলে আরবের আরো অনেক গোত্র ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। বিশ্ববাসীর নিকট মুসলমানদের শৌর্যবীর্য নতুনভাবে প্রকাশিত হয় এবং একথার পুনঃপ্রকাশ ঘটে, “মুসলমানরা সংখ্যা-শক্তির ভিত্তিতে লড়াই করে না, বরং তারা নিজ ঈমানের বলে এবং মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে যু্দ্ধ করে”।

➤[১]বনু লাখাম,জুযাম,বালকীনসহ আরো অনেক গোত্র তাদের সঙ্গে যোগদান করেছিলো।
➤[২]মূতা পূর্ব জর্ডানের কির্ক শহরের দক্ষিণে ১২ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত। মদীনা ও মূতার দূরত্ব ছিলো প্রায় ১১০০ কি.মি.
➤ [৩] শাহাদাতের পর দেখা যায় তাঁর শরীরে ৫০টির বেশী যখমের চিহ্ন ছিলো, অন্য বর্ণনায় ৯৩টির কথা বলা হয়েছে।

তথ্যসূত্র
-সীরাতে ইবনে হিশাম
-আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া
-আররাহীকুল মাখতূম
-নবীয়ে রহমত
-সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া
-তোমাকে ভালোবাসি হে নবী!
-বিবিধ

Previous Post
Next Post
Related Posts