শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২

আলী ইবনে আবী তালিবের (রা.) সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

আলী ইবনে আবি তালিবের সমাধি

আলী ইবনে আবী তালিব (আরবি: علي ابن أبي طالب‎, প্রতিবর্ণী. Ali ibn Abi Talib‎ ; আনু. ১৩ সেপ্টেম্বর ৬০১ – আনু. ২৯ জানুয়ারি ৬৬১)[৫][৬] ছিলেন ইসলামের নবী মুহম্মদের চাচাতো ভাই, জামাতা ও সাহাবি যিনি ৬৫৬ থেকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খলিফা হিসেবে মুসলিম বিশ্ব শাসন করেন। সুন্নি ইসলাম অনুসারে তিনি চতুর্থ রাশিদুন খলিফা। তিনি ছিলেন আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও ফাতিমা বিনতে আসাদের পুত্র, ফাতিমার স্বামী এবং হাসান ও হোসাইনের পিতা।

পরিচিতির কারণ- জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বীরত্ব, সাহসিকতা, নেতৃত্ব, আধ্যাত্মিকতা, দার্শনিকতা, বাগ্মিতা, ন্যায়বিচার

জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ
আলী মক্কায় কুরাইশ বংশে আনুমানিক ৬০১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এই বংশের দ্বায়িত্ব ছিল পবিত্র কাবার রক্ষণাবেক্ষণ করা। এই বংশের একটি শাখা হচ্ছে হাশেমি। আলীর মাতা ও পিতা উভয়েই হাশেমি বংশের ছিলেন। আলীর পিতা আবু তালিব কাবা'র প্রহরী এবং শক্তিশালী কুরাইশ গোত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বানু হাশিমের শেখ ছিলেন৷ আলীর দাদা বনি হাশিম বংশের কিছু সদস্যসহ হানিফ ছিলেন বা উত্থানের পূর্বে একেশ্বরবাদী বিশ্বাস পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন।তাঁর পিতা ছিলেন আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ।ইসলামের ইতিহাসে তিনি সর্বপ্রথম নবুয়ত ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম পুরুষ মানুষ যিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন ও তিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি মুহাম্মাদের সাথে নামাজ আদায় করেন। বদর যুদ্ধ বিশেষ বীরত্বের জন্য মুহাম্মদ তাঁকে জুলফিকার নামক তরবারি উপহার দেন।

কুফায় গুপ্তহত্যাঃ
৪০ হিজরীর ১৯শে রমজান বা ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি মসজিদে কুফায় নামাজ পড়ার সময় তিনি, খারেজী আব্দুর রহমান ইবনে মুলজাম কর্তৃক হামলার শিকার হন। তিনি নামাজে সেজদা দেওয়ার সময় ইবনে মুলজামের বিষ-মাখানো তরবারী দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন।[৩০] আলী তার পুত্রকে নির্দেশ দেন কেউ যেন খারেজীদের আক্রমণ না করে, তার বদলে তিনি নির্দেশ দেন যে, যদি তিনি বেঁচে যান, তবে যেন ইবনে মুলজামকে ক্ষমা করে দেয়া হয়; আর যদি তিনি মারা যান, তবে ইবনে মুলজামকে যেন নিজ আঘাতের সমতুল্য একটি আঘাত করা হয় (তাতে ইবনে মুলজামের মৃত্যু হোক বা না হোক।)।[৩১] আলী হামলার দুদিন পর ২৯শে জানুয়ারি ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে (২১শে রমজান ৪০ হিজরী) মৃত্যুবরণ করেন।

মুহম্মদের ﷺ নেতৃত্বাধীন যুদ্ধসমূহঃ

বদরের যুদ্ধঃ বদরের যুদ্ধ ২ হিজরির ১৭ রমজান মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম প্রধান যুদ্ধ। এতে জয়ের ফলে মুসলিমদের ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।

উহুদের যুদ্ধঃ উহুদের যুদ্ধ ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল উহুদ পর্বতের সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়। মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই দুই পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ও আবু সুফিয়ান। ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত প্রধান যুদ্ধসমূহের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। এর পূর্বে ৬২৪ সালে এই দুইপক্ষের মধ্যে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

খন্দকের যুদ্ধঃ খন্দকের যুদ্ধ বা আহযাবের যুদ্ধ ৫ হিজরিতে সংঘটিত হয়। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। জোট বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ এবং সেসাথে তাদের ৬০০ ঘোড়া ও কিছু উট ছিল। অন্যদিকে মদিনার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ছিল ৩,০০০।

ফাদাক বিজয়ঃ ফাদাক বিজয় ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এবং হিজরী ৭ম সনের দ্বিতীয় মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

খায়বারের যুদ্ধঃ খায়বারের যুদ্ধ ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন আরবের মদিনা নগরী থেকে ১৫০ কিলোমিটার (৯৩ মা) দুরে অবস্থিত খায়বার নামক মরুভূমিতে বসবাসরত ইহুদিগণের সাথে মুসলিমগণের সঙ্ঘটিত একটি যুদ্ধ। মুসলিমদের ইতিহাস অনুসারে, মুসলিমগণ সেখানে দুর্গে আশ্রয় নেয়া ইহুদিদেরকে আক্রমণ করেছিল ।

মুতার যুদ্ধঃ মুতার যুদ্ধ (আরবি: معركة مؤتة, غزوة مؤتة‎‎) হলো মুতার প্রান্তে মুসলমান ও রোমানদের মাঝের একটি যুদ্ধ।

আল-ফুলস অভিযানঃ বনু তাই গোত্রের বিরুদ্ধে আলী ইবনে আবি তালিবের অভিযান, আগস্ট ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ, ৯হিঃ, ইসলামী ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাসে সংঘটিত হয়। পৌত্তলিক দেবতা আল-ফুলস (আল-কুল্লুস) এর মূর্তি (মূর্তি) ধ্বংস করা।

মক্কা বিজয়ঃ ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) খ্রিস্টীয় ৬৩০ অব্দে রক্তপাতহীনভাবে মক্কা নগরী জয় করেন। ইতিহাসে এই ঘটনা মক্কা বিজয় নামে খ্যাত। ঐতিহাসিকদের মতে মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়। এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের পক্ষে আরবের অন্যান্য এলাকা বিজয় করা সহজসাধ্য হয়ে পড়ে।

হুনাইনের যুদ্ধঃ গাজওয়া এ হুনাইন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) ও তার অনুসারীগণ কর্তৃক বেদুঈন গোত্র হাওয়াজিন ও তার উপশাখা সাকিফ এর বিরুদ্ধে মক্কা থেকে তাইফের পথে একটি রাস্তায় ৬৩০ সালে লড়াইকৃত একটি যুদ্ধ। মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধটি সমাপ্ত হয়, তারা অসংখ্য গনিমতের মাল দখল করে নেয়। সূরা তওবাতে এই যুদ্ধের উল্লেখ আছে, যা কুরআনে উল্লেখিত স্বল্পসংখ্যক যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম।

হামদান অভিযানঃ আলী ইবনে আবি তালিবের অভিযান, ইয়েমেনের জনগণকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য ১০ হিজরি বা ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়েছিল।

উটের যুদ্ধঃ ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ যা উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা (Arabic জামালের যুদ্ধ) বা (English: Battle of the Camel) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে তালহা-হযরতজুবায়ের (রাঃ) ও আয়েশা সম্মলিত যুদ্ধ।

সিফফিনের যুদ্ধঃ সিফিনের যুদ্ধ ছিল উটের যুদ্ধের পরে প্রথম ফিতনার দ্বিতীয় যুদ্ধ। রাশিদুন খলিফাদের চতুর্থ আলী ইবনে আবি তালিব এবং প্রথম মুয়াবিয়া এর মধ্যে লড়াই হয় বর্তমান সিরিয়ার শহর রাক্কার আশেপাশে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিফফিন নামক স্থানে। যুদ্ধের দুই মাসেরও বেশি সময় আগে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে শিবির করে এবং অবশেষে ২৬ জুলাই আলীর সেনাবাহিনীতে হামলা চালানো হয় এবং যুদ্ধ ২৮ জুলাই পর্যন্ত চলে । যুদ্ধ শেষ হয় যখন সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে উৎখাত করা হয় কিন্তু হঠাৎ করে উভয় পক্ষ সালিশির বা আলোচনার মাধ্যমে তাদের দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়।
 
নাহরাওয়ানের যুদ্ধঃ ইসলামের প্রথম গৃহযুদ্ধের অন্যতম নাহরাওয়ানের যুদ্ধ ৬৫৮ সালের জুলাই মাসে খলিফা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রা: এবং মুহাক্কামা নামক বিদ্রোহী দলের মধ্যে সংঘটিত হয়। নাহরাওয়ান বাগদাদ ও হেলওয়ানের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি জায়গা। এই যুদ্ধটি ছিল মাওলা আলী রা: ও আমিরে শাম মুয়াবিয়া রা: এর মাঝে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধের ফল, যে যুদ্ধটি বর্শার উপর কুরআন রেখে উত্তোলন করে মধ্যস্থতা চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়েছিল, যা ইশারা করে আল্লাহর কিতাব দিয়ে সালিশের প্রয়োজনীয়তাকে। সে সময় একটি দল সালিশ প্রত্যাখ্যান করে, তাদের সংখ্যা ছিল বারো হাজার, নেতৃত্বে ছিল আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহব আল-রাসেবি, তারা সে সময় তাদের বিখ্যাত স্লোগান তুলেছিল: লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ। তাদের উপর আলী বিন আবি তালিবের সেনাবাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মুহাক্কামীদের মাত্র চল্লিশ জন বেঁচে যান। মুহাক্কামীরা হল খারেজীয়তের মূল এবং এই মিল্লাতের উৎপত্তিস্থল।
Previous Post
Next Post
Related Posts