স্যার মুহাম্মদ ইকবাল (/ˈɪkbɑːl/; উর্দু: محمد اِقبال; ৯ নভেম্বর ১৮৭৭ – ২১ এপ্রিল ১৯৩৮), আল্লামা ইকবাল নামে ব্যাপক পরিচিত, ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুসলিম কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার। তার ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইকবাল তার ধর্মীয় ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন।
বংশ গাজী— গাজী আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল
জন্ম— ৯ নভেম্বর ১৮৭৭; শিয়ালকোট, পাঞ্জাব, ব্রিটিশ ভারত
ইকবাল ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশী, ইরানীয় এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি হিসাবে প্রশংসিত। যদিও ইকবাল বিশিষ্ট কবি হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত, তিনি “আধুনিক সময়ের মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ” হিসাবেও অত্যন্ত প্রশংসিত। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আসরার-ই-খুদী ১৯১৫ সালে পারস্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং কবিতার অন্যান্য গ্রন্থগুলিতে রুমুজ-ই-বেখুদী ,পয়গাম-ই -মাশরিক এবং জুবুর-ই -আজাম। এর মধ্যে তার বিখ্যাত উর্দু রচনাগুলি হ'ল বাং -ই -দারা ,বাল -ই -জিবরাইল এবং আরমাঘান -ই -হিজাজ ।
১৯২২ সালের নিউ ইয়ার্স অনার্সে, রাজা পঞ্চম জর্জ তাকে নাইট ব্যাচেলর এ ভূষিত করে।[৯][১০] দক্ষিণ এশিয়া ও উর্দু-ভাষী বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে ইকবালকে শায়র-ই-মাশরিক' (উর্দু: شاعر مشرق, প্রাচ্যের কবি) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাকে মুফাক্কির-ই-পাকিস্তান (উর্দু: مفکر پاکستان,পাকিস্তানের চিন্তাবিদ ), মুসোয়াওয়ার-ই-পাকিস্তান (উর্দু: مصور پاکستان, "'পাকিস্তানের শিল্পী") এবং হাকিম-উল-উম্মাত (উর্দু: حکیم الامت, "উম্মাহর ভরসা") ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।
তার একটি বিখ্যাত চিন্তা দর্শন হচ্ছে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই চিন্তাই বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। তার নাম মুহাম্মদ ইকবাল হলেও তিনি আল্লামা ইকবাল হিসেবেই অধিক পরিচিত। আল্লামা শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষাবিদ। তার ফার্সি সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ; তিনি ইরানে ইকবাল-ই-লাহোরী নামে পরিচিত।
পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে "পাকিস্তানের জাতীয় কবি" হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার জন্মদিন ইয়াম-ই ওয়েলাদাত-ই মুআম্মাদ ইকবাল (উর্দু: یوم ولادت محمد اقبال, বা ইকবাল দিবস, পাকিস্তানের সরকারী ছুটির দিন হিসাবে পালন করা হয়।[১৩]
ইকবালের বাড়ি এখনও শিয়ালকোটে অবস্থিত এবং এটি ইকবালের মঞ্জিল হিসাবে স্বীকৃত এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। তার অন্য বাড়ি জাভেদ মঞ্জিল লাহোরে অবস্থিত যেখানে তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এবং সেখানেই মারা যান। বর্তমানে এটি জাদুঘর যা পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লাহোর রেলস্টেশনের কাছে আল্লামা ইকবাল রোডে অবস্থিত।
ব্যক্তিগত জীবনঃ
আল্লামা ইকবাল ১৯৩০ সালে তার ছেলে জাবেদ ইকবালের সাথে।
ইকবালের মা, যিনি ১৯১৪ সালের ৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ইকবাল তার মৃত্যুর পরে কাব্যিক আকারে প্যাথো অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন।
ইকবালের জন্ম ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের (বর্তমানে পাকিস্তান) শিয়ালকোটের একটি জাতিগত কাশ্মীরি পরিবারে। তার পরিবার হলেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ সাপ্রু যারা ইসলাম গ্রহণ করে। উনিশ শতকে, শিখ সাম্রাজ্য যখন কাশ্মীর জয় করছিল, তখন তার দাদার পরিবার পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে গিয়ে বসবাস শুরু করে। ইকবাল প্রায়শই তার লেখায় কাশ্মীরি বংশের ধারা উল্লেখ ও স্মরণ করতো।
তার দাদা শেখ রফিক কাশ্মিরী শাল তৈরি ও ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তার দু’জন পুত্র ছিলেন শেখ গোলাম কাদির এবং শেখ নুর মোহাম্মদ। ইকবালের বাবা শেখ নূর মুহাম্মদ (মৃত্যু: ১৯৩০) তিনি ছিলেন দর্জি, আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নন, তিনি একজন ধর্মীয় মানুষ ছিলেন। শেখ নুর মোহাম্মদ কেবল পেশাগত দিক দিয়ে নয়, চিন্তাধারা এবং জীবন যাপনে ছিলেন ইসলামের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত-প্রাণ। সুফি সঙ্গীদের কাছে তার প্রচণ্ড সম্মান ছিল। তার স্ত্রী, মোহাম্মদ ইকবালের মা ইমাম বিবিও ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা। তিনি ১৯১৪ সালের ৯ নভেম্বর শিয়ালকোটে মারা যান। এই দম্পতি তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর অনুভূতির জন্ম দেন।
আল্লামা ইকবালের শিক্ষাজীবনঃ
১৮৯৯-এ ইকবাল পাঞ্জাবের ব্রিটিশ আর্মির কাছে শিখদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টান মিশনারিরা শিয়ালকোটে শিক্ষা প্রচারের উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এই সময়েই শিয়ালকোটে স্কটিশ মিশন কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজ লিবারেল আর্টস্ এর কোর্সসমূহের অনেকগুলোতেই আরবি ও ফার্সি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হতো। যদিও এই সময় বেশির ভাগ স্কুলেই ফার্সি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। এই স্কটিশ মিশন কলেজেই ইকবাল সর্বপ্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রাপ্ত হন।
ইকবাল তার কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি পান তার শিক্ষক সাইয়িদ মীর হাসানের কাছ থেকে। ১৮৮৫ সালে স্কটিশ মিশন কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ইকবাল লাহোরের সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন, এখান থেকে তিনি স্বর্ণ পদক নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯২ সালে ইকবাল স্কটিশ মিশন কলেজ হতে তার পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে চারুকলা অনুষদ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৮৯৯ সালে যখন তিনি মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন ততদিনে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।
মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়বার সময় ইকবাল স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে আসেন। এই শিক্ষাবিদ ইসলাম ও আধুনিক দর্শনে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইকবালের কাছে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। স্যার টমাস আর্নল্ডই ইকবালকে ইউরোপে উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন।
বিবাহঃ
ইকবাল বিভিন্ন সময় প্রয়োজন ও পরিস্থিতিতে তিনবার বিয়ে করেছিলেন। ১৮৯৫ সালে ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম বিবাহ হয়েছিল। গুজরাটি চিকিৎসকের মেয়ে করিম বিবির সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের বিচ্ছেদ হয় ১৯১৬ সালে। এই দম্পত্তির তিনটি সন্তান ছিল। যার মধ্যে মেয়ে মিরাজ বেগম (১৮৯৯-১৯১৫) এবং ছেলে আফতাব ইকবাল (১৮৯৯-১৯৭৯) যিনি ব্যারিস্টার হয়েছেন ১৯০১ সালে জন্মের পরে তার আরেক পুত্র মারা গেছেন বলে জানা যায়। ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে ইকবালের মা মারা যাওয়ার পরের নভেম্বর মাসে ইকবালের দ্বিতীয় বিবাহ মুখতার বেগমের সাথে অনুষ্ঠিত হয়। তাদের একটি পুত্র ছিল, তবে মা এবং পুত্র উভয়ই ১৯৪৪ সালে জন্মের পরেই মারা যান। পরে ইকবাল সরদার বেগমকে বিয়ে করেন, তাদের দুই সন্তান, ছেলে জাভেদ ইকবাল এবং মেয়ে মুনিরা বানু।
ইউরোপে ইকবালঃ
পশ্চিমে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য ইকবাল, লাহোর সরকারী কলেজের দর্শনের শিক্ষক স্যার টমাস আর্নল্ডের দ্বারা অনেকাংশেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে, তিনি সেই উদ্দেশ্যেই ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। তিনি ফ্রেডরিখ নিটশে, হেনরি বার্গসঙ্কে ভালভাবেই চিনতেন এবং মাওলানা রুমির ব্যাপারে তিনি ইংল্যান্ড যাবার আগেই কিছুটা পরিচিত ছিলেন। সে সময় ইকবাল তার বন্ধু স্বামী রাম তীর্থকে মসনভি শেখাতেন, যার বিনিময়ে তিনি তাকে সংস্কৃত শেখাতেন। ইকবাল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ থেকে বৃত্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং ১৯০৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এই বি.এ. ডিগ্রি লন্ডনে তাকে আইন পেশা অনুশীলন করার সুযোগ দিয়েছিলো। একই বছর তাকে লিঙ্কনস ইন. এ ব্যারিস্টার হিসেবে ডাকা হয়।
১৯০৭ সালে, ইকবাল পিএইচডিতে অধ্যয়ন করার জন্য জার্মানিতে চলে যান এবং ১৯০৮ সালে মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অফ ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ফ্রেডরিখ হোমেলের নির্দেশনায় কাজ করতেন। ইকবালের ডক্টরেট থিসিসটির শিরোনাম ছিল দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া। মিউনিখে তার ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন হ্যান্স-হাসো ভন ভেলথেইম যিনি কাকতালীয় ভাবে ইকবালের মৃত্যুর আগের দিন ইকবালের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন।১৯০৭ সালে, ব্রিটেন এবং জার্মানির লেখক আতিয়া ফাইজির সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। আতিয়া পরবর্তীতে তাদের চিঠিপত্র প্রকাশ করে। ইকবাল যখন ১৯০৭ সালে হাইডেলবার্গে ছিলেন, তখন তার জার্মান অধ্যাপক এমা ওয়েজেনাস্ট তাকে গোথের ফাউস্ট, হেইন এবং নিটশে সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন। তিনি তিন মাসে জার্মান ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ইউরোপে অধ্যয়নকালে ইকবাল ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি এই ভাষায় লিখতে পছন্দ করতেন কারণ এটি তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করাকে সহজ করে তোলে। পরবর্তীতে, তিনি সারাজীবন ফারসি ভাষায় ক্রমাগত লিখেছিলেন।
রাজনীতিঃ
বৃটেনে থাকতেই ইকবাল সর্বপ্রথম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই তিনি তাতে যোগ দেন। দলের ব্রিটিশ চ্যাপ্টারের নির্বাহী কমিটিতে নির্বাচিত হন ইকবাল। সৈয়দ হাসান বিলগামী এবং সৈয়দ আমির আলির সাথে তিনি উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে মুসলিম লীগের খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করেন। এর পর ১৯২৬ সালে তিনি লাহোরের মুসলিম লীগের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন।
পেশাগত জীবনঃ
১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ হতে দেশে ফিরে আসেন এবং লাহোরের সরকারি কলেজে যোগদান করেন। এই সময় একই সাথে তিনি আইন ব্যবসা, শিক্ষাদান ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ইকবাল কেবল একজন উঁচুমানের লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পরিচিত আইনজীবীও। তিনি দেওয়ানী ও ফৌজদারি উভয় বিষয়েই লাহোর হাইকোর্টে হাজির থাকতেন। তার নামে ১০০ টিরও বেশি রায় দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি তার সাহিত্যর জন্যে বেশি সময় ব্যয় করতেন। তিনি তার পিতাকে প্রতিজ্ঞা করেন যে কবিতার বিনিময়ে কোনো অর্থ তিনি গ্রহণ করবেন না। অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে তিনি সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেন নি। ইতোমধ্যেই বিখ্যাত কবি ইকবালকে ব্রিটিশ সরকার “আসরার-ই-খোদায়ী” পুস্তকের জন্য নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।
আল্লামা ইকবালের দর্শন ও সাহিত্যঃ
আল্লামা ইকবাল তার কয়েকটি কবিতা ও রচনার জন্য অমর হয়ে আছেন। এরমধ্যে আসরার ই খুদি, শিকওয়া ও জবাবে শিকওয়া, দ্যা রিকনস্ট্রাকশন ওফ রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম, বাআল ই জিবরাইল, জাভেদ নামা ইত্যাদি অত্যন্ত গভীর দার্শনিক ভাব সমৃদ্ধ রচনা। আল্লামা ইকবালের লেখনিতে যে ইসলামী পুনর্জাগরণের আওয়াজ উঠেছিল তা সমসাময়িক অনেক ব্যক্তি ও আন্দোলনকে বহুলভাবে প্রভাবিত করেছে। তার দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি পাকিস্তানের কায়েদে আজম। তার ইসলামী পুনর্জাগরণের চেতনাকে সারা জীবনের তরে জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে একটি পুনর্জাগরণী দলের জন্ম দেন তার স্নেহধন্য সৈয়দ আবুল আ'লা মওদুদি। যার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখিয়েছে। আল্লামা ইকবাল শিয়া চিন্তানায়কদেরকেও প্রভাবিত করেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চিন্তানায়ক ড. আলি শরিয়তিও আল্লামা ইকবাল দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
আল্লামা ইকবালের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ–
১. ইলম আল ইক্তিউদ (The Science of Economics)- উর্দু ছন্দে (ca ১৯০১)
২. Islam as an Ethical and Political Ideal- ইংরেজি (১৯০৮)
৩. The Development of Metaphysics in Persia- ইংরেজি (১৯০৮) ( বাংলা অনুবাদ : প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান)
৪. আসরার ই খুদি (The Secrets of the Self)- ফার্সি (১৯১৫)
৫. রুমিজ ই বেখুদি (The Mysteries of Selflessness)- ফার্সি (১৯১৭)
৬. পয়গাম ই মাশরিক (The Message of the East)- ফার্সি (১৯২৩)
৭. বাং ই দারা (The Call of the Marching Bell)- উর্দু ও ফার্সি (১৯২৪)
৮. জুবুর ই আজাম (The Psalms of Persia)- ফার্সি (১৯২৭)
৯. The Reconstruction of Religious Thought in Islam- (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) (১৯৩০)
১০. জাভেদ নামা (The Book of Eternity)- ফার্সি (১৯৩২)
১১. বাল ই জিবরাইল (The Gabriel’s Wings)- উর্দু ও ফার্সি (১৯৩৩)
১২. পাস ছে বায়াদ কারদ আই আক্বওয়াম ই শারক (So What Should be Done O Oriental Nations)- ফার্সি (১৯৩৬)
১৩. মুসাফির (The Wayfarer)- ফার্সি (১৯৩৬)
১৪. জারব ই কালিম (The Blow of Moses) উর্দু ও ফার্সি (১৯৩৬)
১৫. আরমাঘান ই হিজাজ (The Gift for Hijaz)- ফার্সি ও উর্দু (১৯৩৮)[৩৩]
আল্লামা ইকবালের ইন্তেকালঃ
লাহোরের বাদশাহী মসজিদের প্রবেশপথে ইকবালের কবর।
১৯৩৩ সালে, স্পেন এবং আফগানিস্তান ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর, ইকবাল গলায় একধরণের অজ্ঞাত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তিনি শেষ কয়েকটি বছর চৌধুরী নিয়াজ আলী খানকে পাঠানকোটের কাছে জামালপুরে দার উল ইসলাম ট্রাস্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন, যেখানে তার ধ্রুপদী ইসলাম এবং সমসাময়িক সামাজিক বিজ্ঞানের অধ্যয়নে ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তিনি একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষেও ছিলেন। ইকবাল ১৯৩৪ সালে আইন পেশা বন্ধ করে দেন, এরপর থেকে ভোপালের নবাব তাকে পেনশন প্রদান করত। তার শেষ বছরগুলিতে, তিনি প্রায়শই আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার জন্য লাহোরে বিখ্যাত সুফি আলী হুজভিরির দরগায় যেতেন। কয়েক মাস অসুস্থ থাকার পর, ইকবাল ২১ শে এপ্রিল ১৯৩৮ সালে লাহোরে মারা যান। তার সমাধি বাদশাহী মসজিদের গেইট এবং লাহোর ফোর্টের মাঝামাঝি হুজুরিবাগের বাগানে অবস্থিত এবং পাকিস্তান সরকার সেখানে নিরাপত্তা প্রদান করে।
প্রচেষ্টা এবং প্রভাব
ইসলামী নীতির পুনরুজ্জীবনঃ
ইকবালের ছয়টি ইংরেজি বক্তৃতা ১৯৩০ সালে লাহোরে এবং তারপরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা ১৯৩৪ সালে ইসলাম ধর্মের পুনর্গঠন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। যে বক্তৃতাগুলো মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ এবং আলীগড়ে দেওয়া হয়। এই বক্তৃতাগুলি আধুনিক যুগে ধর্ম এবং রাজনৈতিক ও আইনী দর্শন হিসাবে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে। এই বক্তৃতাগুলিতে ইকবাল মুসলিম রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক মনোভাব এবং আচরণকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যাদের তিনি নৈতিকভাবে বিপথগামী, ক্ষমতার সাথে সংযুক্ত এবং মুসলিম জনগণের পাশে দাঁড়ানো ছাড়াই দেখেছিলেন।
ইকবাল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা শুধুমাত্র ইসলাম এবং মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক ভিত্তিকেই দুর্বল করবে না ভারতের হিন্দু -সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলিম ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে ভিড় করবে। মিশর, আফগানিস্তান, ইরান এবং তুরস্কে তার ভ্রমণে, তিনি বৃহত্তর ইসলামি রাজনৈতিক সহযোগিতা ও ঐক্যের ধারণা প্রচার করে, জাতীয়তাবাদী পার্থক্য দূর করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিষয়েও অনুমান করেছিলেন; ড: বি আর আম্বেদকরের সাথে একটি সংলাপে, ইকবাল ভারতীয় প্রদেশগুলিকে ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে এবং কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকার ছাড়াই স্বায়ত্তশাসিত হিসাবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ভারতে স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম অঞ্চলের আশা করেছিলেন। একটি একক ভারতীয় ইউনিয়নের অধীনে, তিনি মুসলমানদের জন্য ভয় পেয়েছিলেন, যারা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, বিশেষ করে মুসলমান হিসাবে তাদের অস্তিত্বগতভাবে পৃথক সত্তার বিষয়ে।
ইকবাল ১৯৩০ সালে ইউনাইটেড প্রদেশের এলাহাবাদে মুসলিম লীগের অধিবেশনে এবং ১৯৩২ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৩০-এ তার রাষ্ট্রপতির ভাষণে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেন:
“আমি দেখতে চাই পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধ এবং বেলুচিস্তান -কে একটি একক রাজ্য হিসেবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর মধ্যে স্ব-শাসন, বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ব্যতীত, একটি সংহত উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠন আমার কাছে অন্তত উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চূড়ান্ত নিয়তি বলে মনে হয়।”
ইকবাল তার বক্তৃতায় জোর দিয়েছিলেন যে, খ্রিস্টধর্মের বিপরীতে, ইসলাম "নাগরিক তাৎপর্য" সহ "আইনি ধারণা" নিয়ে এসেছে, যার "ধর্মীয় আদর্শ" সামাজিক ব্যবস্থা থেকে অবিচ্ছেদ্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছে: "অতএব, যদি এর অর্থ ইসলামের নীতির স্থানচ্যুতি হয়। সংহতি, জাতীয় আইনে একটি নীতি নির্মাণ, একজন মুসলমানের পক্ষে কেবল অচিন্তনীয়।" ইকবাল এইভাবে শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ঐক্যের প্রয়োজনেই নয় বরং ইসলামী নীতির উপর ভিত্তি করে নয় এমন একটি বৃহত্তর সমাজে মুসলিম জনসংখ্যাকে মিশ্রিত করার অবাঞ্ছিততার উপর জোর দেন।
এইভাবে তিনি প্রথম রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন যেটি দ্বি-জাতি তত্ত্ব হিসাবে পরিচিত হবে - যে মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং এইভাবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল ও সম্প্রদায় থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার যোগ্য।যদিও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তিনি তার আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রটি ধর্মতন্ত্র হবে কিনা তা ব্যাখ্যা বা নির্দিষ্ট করবেন না, এবং ইসলামী পন্ডিতদের (ওলামা) "বুদ্ধিবৃত্তিক মনোভাব"কে "ব্যবহারিকভাবে ইসলামের আইনকে অচলাবস্থায় হ্রাস করেছে" বলে সমালোচনা করেছেন। "
ইকবালের জীবনের শেষভাগ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীভূত ছিল। দলের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থিক সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তার ১৯৩২ সালের ভাষণের ধারণাগুলি পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন এবং তৃতীয় গোলটেবিল সম্মেলনের সময়, তিনি কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন এবং মুসলিম প্রদেশগুলির জন্য যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা ছাড়াই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব করেছিলেন।
তিনি পাঞ্জাব মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং একক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ভারতজুড়ে মুসলমানদের সমাবেশ করার প্রয়াসে বক্তৃতা দেবেন এবং নিবন্ধ প্রকাশ করবেন। ইকবাল ধারাবাহিকভাবে পাঞ্জাবের সামন্ত শ্রেণীর পাশাপাশি লীগের বিরোধিতাকারী মুসলিম রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেছেন।কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি ইকবালের হতাশার অনেক বিবরণও দ্বি-জাতি তত্ত্বের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের ক্ষেত্রে মুখ্য ছিল।
তোলু-ই-ইসলামের পৃষ্ঠপোষকঃ
তোলু-ই-ইসলামের প্রথম সংখ্যার কপি; ইকবাল ছিলেন টলু-ই-ইসলামের প্রথম পৃষ্ঠপোষক, ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের একটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পত্রিকা। দীর্ঘকাল ধরে, ইকবাল তার ধারণা এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রচারের জন্য একটি জার্নাল চেয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে, তার নির্দেশ অনুসারে, সৈয়দ নাজির নিয়াজী ইকবালের “তুলুই ইসলাম” কবিতার নামানুসারে জার্নালের সূচনা ও সম্পাদনা করেন। নিয়াজী জার্নালের প্রথম সংখ্যা ইকবালকে উৎসর্গ করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরে, গোলাম আহমেদ পারভেজ জার্নালটি চালিয়ে যান , যিনি এর প্রথম সংস্করণে অনেক নিবন্ধ অবদান রেখেছিলেন।
সাহিত্য কর্মঃ
ফার্সি—
ইকবালের কাব্য রচনাগুলি মূলত উর্দু না হয়ে ফার্সি ভাষায় লেখা হয়।তার ১২,০০০টি কবিতার মধ্যে প্রায় ৭,০০০টি শ্লোক ফারসি ভাষায়। ১৯১৫ সালে, তিনি ফার্সি ভাষায় তার প্রথম কবিতার সংকলন, আসরার-ই- اسرارِ خودی ( নিজের রহস্য ) প্রকাশ করেন।কবিতাগুলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মা ও আত্মকে জোর দেয়।অনেক সমালোচক একে ইকবালের শ্রেষ্ঠ কাব্য রচনা বলে অভিহিত করেছেন। আসরার-ই-খুদিতে, ইকবাল তার "খুদি" বা "আত্ম" এর দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। ইকবালের "খুদি" শব্দের ব্যবহারটি একটি ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের জন্য কুরআনে ব্যবহৃত "রুহ" শব্দের সমার্থক, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, এবং ইকবাল বলেছিলেন যে তিনি আদমের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন, যার জন্য আল্লাহ সমস্ত আদেশ দিয়েছেন। ফেরেশতারা আদমের সামনে সিজদা করবে। ইকবাল আত্ম-ধ্বংসের নিন্দা করেন।তার কাছে জীবনের লক্ষ্য হল আত্ম-উপলব্ধি এবং আত্ম-জ্ঞান।তিনি সেই পর্যায়গুলি লেখেন যেগুলির মধ্য দিয়ে "আত্ম"কে পরিপূর্ণতার বিন্দুতে পৌঁছানোর আগে অতিক্রম করতে হয়, "আত্ম" সম্পর্কে জ্ঞান আল্লাহর প্রতিনিধি হতে সক্ষম করে।
ইকবাল তার রমুজ-ই-বেখুদি رموزِ بیخودی (নিঃস্বার্থতার ইঙ্গিত ) গ্রন্থে ইকবাল প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে ইসলামি জীবন বিধান একটি জাতির কার্যক্ষমতার জন্য সর্বোত্তম আচরণবিধি।একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই তার বৈশিষ্ট্যগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে, তিনি জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু একবার এটি অর্জন করা হলে, জাতির প্রয়োজনে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিতে হবে।মানুষ সমাজের বাইরে গিয়ে ‘আত্ম’ উপলব্ধি করতে পারে না।১৯১৭ সালে প্রকাশিত, এই গোষ্ঠীর কবিতার মূল বিষয়বস্তু আদর্শ সম্প্রদায়, ইসলামী নৈতিক ও সামাজিক নীতি এবং ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক।যদিও তিনি ইসলামকে সমর্থন করেন, ইকবাল অন্যান্য ধর্মের ইতিবাচক দিকগুলোও স্বীকার করেন।রুমুজ-ই-বেখুদি ও আসরার-ই -খুদি এ দুটি সংকলন প্রায়শই আসরার-ই-রুমুজ ( ইঙ্গিত গোপনীয়তা ) শিরোনামে একই ভলিউমে রাখা হয়। এটি বিশ্বের মুসলমানদের উদ্দেশে বলা হয়েছে।
ইকবালের ১৯২৪ সালের প্রকাশনা, পেয়াম-ই-মাশরিক پیامِ مشرق ( প্রাচ্যের বার্তা ), জার্মান কবি গোয়েথে দ্বারা পশ্চিম-ওস্টলিচার দিওয়ানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।গোয়েথে পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গিতে খুব বেশি বস্তুবাদী হয়ে উঠেছে বলে শোক প্রকাশ করেন এবং আশা করেন প্রাচ্য আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আশার বার্তা দেবে।ইকবাল পাশ্চাত্যকে নৈতিকতা, ধর্ম ও সভ্যতার গুরুত্ব ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অনুভূতি, উদ্দীপনা ও গতিশীলতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়েছেন। তিনি দাবি করেন যে একজন ব্যক্তি কখনই উচ্চ মাত্রার আকাঙ্ক্ষা করতে পারে না যদি না সে আধ্যাত্মিকতার প্রকৃতি সম্পর্কে শিখে। আফগানিস্তানে তার প্রথম সফরে তিনি রাজা আমানুল্লাহ খানের কাছে পায়াম-ই মাশরেক উপহার দেন।এতে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের বিদ্রোহের প্রশংসা করেন।তাকে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সভায় যোগদানের জন্য ১৯৩৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
১৯২৭ সালে প্রকাশিত জাবুর -ই-আজম زبورِ عجم (পার্সিয়ান সামস) এর মধ্যে রয়েছে " গুলশান-ই-রাজ-ই-জাদেদ " ("নতুন রহস্যের উদ্যান") এবং " বন্দগী নামা " ("দাসত্বের বই") কবিতা। )" গুলশান-ই-রাজ-ই-জাদেদ "-এ ইকবাল প্রথমে প্রশ্ন তোলেন, তারপর প্রাচীন ও আধুনিক অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে উত্তর দেন।" বন্দগী নামা " দাসত্বের নিন্দা করে এবং দাস সমাজের চারুকলার পেছনের চেতনা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।এখানে, অন্যান্য বইয়ের মতো, ইকবাল আদর্শ জীবনকে পরিপূর্ণ করার জন্য ভালবাসা, উদ্যম এবং শক্তির উপর জোর দেওয়ার সাথে সাথে অতীতকে স্মরণ করার, বর্তমানকে ভাল করার এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন।
ইকবালের ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় জাভেদ নামা جاوید نامہ ( জাভেদের বই ), যেটি তার ছেলের নামে এবং একটি পদ্ধতিতে নামকরণ করা হয়েছে, যেটি কবিতাগুলিতে প্রদর্শিত হয়েছে।এটি ইবনে আরাবি এবং দান্তের দ্য ডিভাইন কমেডির কাজের উদাহরণগুলি অনুসরণ করে, সময় জুড়ে রহস্যময় এবং অতিরঞ্জিত বর্ণনার মাধ্যমে।ইকবাল নিজেকে জিন্দা রুদ ("জীবনে পূর্ণ একটি স্রোত") হিসাবে চিত্রিত করেছেন রুমি, "গুরু" দ্বারা পরিচালিত, বিভিন্ন স্বর্গ ও গোলকের মধ্য দিয়ে এবং দেবত্বের কাছে যাওয়ার এবং ঐশ্বরিক আলোর সংস্পর্শে আসার সম্মান পেয়েছেন।একটি ঐতিহাসিক সময়কে পুনর্জীবিত করার একটি অনুচ্ছেদে, ইকবাল মুসলমানদের নিন্দা করেছেন যারা বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং মহীশূরের টিপু সুলতানের পরাজয় ও মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের সুবিধার জন্য তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এবং এইভাবে তাদের দেশকে দাসত্বের শিকলে আবদ্ধ করে।শেষ পর্যন্ত, তার ছেলে জাভেদকে সম্বোধন করে, তিনি তরুণদের সাথে কথা বলেন, এবং "নতুন প্রজন্মকে" গাইড করেন।
পাস চিহ বায়েদ কারদ আই আকওয়াম-ই- শর্ক پس چہ چاہیے مسافر پس چہ باید کرد اے اقوامِ شرق কবিতাটি " মুসাফির " ("যাত্রী") অন্তর্ভুক্ত করেছে।আবার, ইকবাল রুমিকে একটি চরিত্র হিসাবে চিত্রিত করেছেন এবং ইসলামী আইন ও সুফি ধারণার রহস্যের একটি প্রকাশ করেছেন। ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের পাশাপাশি মুসলিম জাতির মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।" মুসাফির " হল ইকবালের আফগানিস্তানে যাত্রার একটি বিবরণ, যেখানে পশতুন জনগণকে "ইসলামের গোপনীয়তা" শিখতে এবং নিজেদের মধ্যে "নিজেকে গড়ে তুলতে" পরামর্শ দেওয়া হয়।
ফারসি ভাষার প্রতি তার ভালোবাসা তার রচনা ও কবিতায় স্পষ্ট। তিনি তার একটি কবিতায় বলেছেন:
گرچہ ہندی در عذوبت شکر است
garchi Hindi dar uzūbat shakkar ast
طرز گفتار دري شيرين تر است
tarz-i guftar-i Dari shirin tar ast
অনুবাদ: যদিও মাধুর্য হিন্দিতে * [উর্দুরজন্য প্রাচীন নাম, lit. "ভারতের ভাষা"] হল চিনি - (কিন্তু) দারিতে বক্তৃতা পদ্ধতি [আফগানিস্তানে ফার্সি ভাষার বিভিন্নতা] মিষ্টি *
সারা জীবন, ইকবাল ফারসি ভাষায় লেখা পছন্দ করতেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি তাকে দার্শনিক ধারণাগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে দেয় এবং এটি তাকে ব্যাপক শ্রোতা দেয়।
উর্দু—
১৯৩৫ সালে লেডি অটোলিন মরেল দ্বারা স্যার মুহম্মদ ইকবালের ছবি মুহাম্মদ ইকবালের দ্য কল অফ দ্য মার্চিং বেল ( بانگِ درا, বাং -ই দারা ), তার প্রথম উর্দু কবিতার সংকলন, ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।এটি তার জীবনের তিনটি স্বতন্ত্র পর্বে রচিত হয়েছিল। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি যে কবিতাগুলি লিখেছিলেন - যে বছর তিনি ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন - উর্দু ভাষার দেশপ্রেমিক " সারে জাহান সে আচ্চা ", এবং " তারানা-ই-মিলি " ("দ্য গান) সহ দেশপ্রেম এবং প্রকৃতির চিত্র প্রতিফলিত করে সম্প্রদায়ের")।কবিতার দ্বিতীয় সেটটি ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে, যখন ইকবাল ইউরোপে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ইউরোপীয় সমাজের প্রকৃতির উপর আলোকপাত করেছিলেন, যার উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন সেটি হল আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে।এটি ইকবালকে বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি সহ ইসলাম এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল।ইকবাল ইসলামের মূল্যবোধ ও শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য উম্মাহ হিসেবে সম্বোধন করা সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
ইকবালের কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় ফারসি ভাষায় ছিল, কিন্তু ১৯৩০ সালের পর তার কাজগুলি মূলত উর্দুতে ছিল।এই সময়ের মধ্যে তার কাজগুলি প্রায়শই ভারতের মুসলিম জনসাধারণের দিকে বিশেষভাবে পরিচালিত হয়েছিল, ইসলাম এবং মুসলিম আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের উপর আরও জোরালো জোর দিয়ে।১৯৩৫ সালে প্রকাশিত, বাল-ই-জিব্রিল بالِ جبریل ( জিবরাঈলআঃ-এর ডানা ) কে অনেক সমালোচক তার সেরা উর্দু কবিতা বলে মনে করেন এবং তার স্পেন সফরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যেখানে তিনি মুরস রাজ্যের স্মৃতিস্তম্ভ এবং উত্তরাধিকার পরিদর্শন করেছিলেন।এটি গজল, কবিতা, কোয়াট্রেন এবং এপিগ্রাম নিয়ে গঠিত এবং ধর্মীয় আবেগের একটি শক্তিশালী অনুভূতি বহন করে।
জারব-ই-কালিম ضربِ کلیم (বা দ্য রড অফ মোজেস) হল উর্দু ভাষায় আল্লামা ইকবালের আরেকটি দার্শনিক কবিতার বই, এটি তার মৃত্যুর দুই বছর আগে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
আধুনিক খ্যাতিঃ
"প্রাচ্যের কবি’’
১৯৩৩ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাহিত্যে ডক্টরেট উপাধি প্রদানের পর আল্লামা ইকবাল শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া ইকবালকে "প্রাচ্যের কবি" বলে উল্লেখ করেছে।
কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ড. মাসুম ইয়াসিনজাই, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের একটি বিশিষ্ট সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে এক সেমিনারে বলেন যে ইকবাল কেবল প্রাচ্যের কবিই নন, একজন সর্বজনীন কবি। তদুপরি, ইকবাল বিশ্ব সম্প্রদায়ের কোনো নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, তিনি সমগ্র মানবতার জন্য।
তবুও এটাও মনে রাখা উচিত যে তার পূর্ব দিভান গ্যাটেকে উৎসর্গ করার সময়, সাংস্কৃতিক আইকন সমান শ্রেষ্ঠত্ব, ইকবালের পায়াম-ই-মাশরিক গোয়েথে-এর পশ্চিম দিভানের জন্য একটি উত্তর এবং সংশোধনমূলক উভয়ই গঠন করেছিল। কেননা নিজেকে প্রাচ্যের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করে ইকবাল পশ্চিমের প্রতিনিধি হিসেবে গ্যাটের সাথে সমান শর্তে কথা বলার চেষ্টা করেন।
ইকবালের বিপ্লবী কাজ তার কবিতার মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রভাবিত করেছিল। ইকবাল মনে করতেন, পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক প্রসার ও বৃদ্ধির কারণে মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরে দমিয়ে আছে। এই ধারণার জন্য ইকবালকে ‘প্রাচ্যের কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সুতরাং উপসংহারে, আমি "জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এর উইং"-এ অ্যানেমারি শিমেল উদ্ধৃত করি যিনি ইকবালের "পূর্ব এবং পশ্চিম সুতা থেকে চিন্তার একটি দুর্দান্ত ট্যাপেস্ট্রি বুননের অনন্য উপায়" (p. xv), একটি সৃজনশীল কার্যকলাপের প্রশংসা করেন। আমার নিজের ভলিউম রিভিশনিং ইকবালকে উদ্ধৃত করার জন্য, মুহাম্মদ ইকবালকে একজন "সর্বজনীন কবি" এবং চিন্তাবিদ হিসাবে সম্মানিত করেছেন যার প্রধান লক্ষ্য ছিল "প্রাচ্য" এবং "পশ্চিম" এর মধ্যে একটি সেতু নির্মাণের জন্য বিত।