কোমলতার কিংবা কঠোরতা, ন্যায়ের পথে অবিচল আর অন্যায়ের প্রতি আপোষহীন, সহজ সরলতা’র সাথে বিচক্ষণতা এ-সবের অনন্য সমন্বয় তার চরিত্রে এনে দিয়েছিল সমুচিত এক অনবদ্য জীবন শৈলী।
ভদ্র প্রকৃতির তবে সিদ্ধান্তে দৃঢ়চিত্ত, ক্ষমাশীল কিন্তু অতটা নয়, তুমুল ক্ষমতা আর জনপ্রিয়তা অথচ অনাড়ম্বর’তা দেখে টের পাওয়া বেশ দুর্বোধ্য। সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা আর খ্যাতি কী ছিলনা, উচ্চ পদমর্যাদা আর বিত্তশালী জীবনযাত্রার সব উপাদান। এত্ত সবের মধ্যে খুব সাধারণ জীবন যাপন – যেখানে শাসক শ্রেণী থেকে প্রজা,ধনী কিংবা গরিব উঁচু নিচু সবার সাথে মিশে যাওয়া যায়! হ্যা, তিনি এরকম জীবন অতিবাহিত করতে পেরেছিলেন! তিনি গতানুগতিক কেউ নন আর দশ জন শাসকের চেয়ে আলাদা তদানিন্তন অর্ধ্ব পৃথিবীর অধিপতি মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব।
❐শুরুর দিকে,
যুদ্ধাংদেহী মনোভাব, বীরত্ব, রুক্ষতা আর আক্রমণাত্নক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য শুরু থেকেই কোরাইশদের কাছে যেনো উমরের জুড়ি মেলা ভার, তবে তার সুনির্দিষ্ট আরেকটি কারণ’ও আছে, তখনকার মক্কায় হাতেগোনা যে কয়জন শিক্ষিত ছিলেন তাদের মধ্যে উমর একজন! তিনি শুধু শিক্ষিত’ও নন সাথে আরবের একজন নামজাদা কুস্তিগির’ও! উনার ক্ষেত্রে এক মহা ব্যাপার স্যাপার’ই ভাবা যায়।
শিক্ষিত হওয়ার মতো দুর্লভ গুনাবলির জন্য কোরাইশদের কাছে খ্যাতি অর্জনে দিন গুনতে হয়নি উমরের।
আনুমানিক ৫৮০–৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনু আদি গোত্রে জন্ম নেন উমর। পিতা খাত্তাব ইবনে নুফাইল এবং মাতা হানতামা। জন্মের পর বাবা মা তাকে ‘হাফস’ বলেই ডাকতেন। কোরাইশদের মধ্যে পিতা ইবনে নুফাইলের অবস্থান বেশ সুদৃঢ় থাকার পাশাপাশি মাতা হানতামা ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি হিসাম ইবনে মুগিরা’র কন্যা।
তরবারি চালনার কৌশল, এর মাঝে ব্যাবসা বানিজ্যে মনযোগ কিংবা হঠাৎ কবিতা প্রীতি সাথে কুস্তি খেলায় নিজের তবিয়ত টিকিয়ে রাখা পক্ষান্তরে মক্কার অলিগলি’তে দাপুটে পদচারণা এসবের মধ্যেই ছিলেন উমর। তেজস্বী ব্যাক্তিত্ব, অগ্নি ঝরানো বাগ্নী’তা, বজ্র কন্ঠের এক মল্লযুদ্ধবিশারদ বিকল্পে একজন পুরোদস্তর বণিক! অনেকের মতে উমরের প্রাথমিক জীবনের এই বর্ণিল রুপ পরবর্তী কালে তার দীর্ঘ যাত্রাকে অনেকাংশেই সুগম করেছিল।
❐ ইসলাম ধর্মে উমর
অনেকটা খামখেয়ালি ভাবেই দিন যাচ্ছিল উমরের একদিন পথিমধ্যে শুনলেন কে যেনো বাপ দাদার ধর্মে চুনকালি মেরে নতুন ধর্ম নিয়ে আবির্ভাব হয়েছে!
কে সে? উত্তরে নাম আসলো— মোহাম্মদ!
কসম তরবারি উন্মুক্ত করে যাচ্ছি মোহাম্মদ’কে হত্যা না করে ফিরব না!
কিন্ত যাত্রাপথে বাধার সম্মুখিন হলেন; শুনলেন নিজের বোন ফাতিমা এবং বোনের স্বামী সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। উমর এই উদ্ভট খবর শুনে মুহাম্মদ থেকে ফিরে গেলেন! রাগান্বিত হয়ে ওই দুই জনের বাড়ির দিকে চলে গেলেন এবং প্রচন্ড প্রহার করে ইসলাম বিমুখ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু ব্যার্থ হলেন। ইসলাম ধর্মের উপর ফাতিমা এবং সাঈদের অবিচল মনোভাব উমর’কে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উদ্ভুদ্ধ করেছিল বলে মনে করা হয়।
(সংক্ষেপিত) [ইতিহাসে মতবেদ রয়েছে]
ইসলাম ধর্ম গ্রহণে এবং ইসলাম প্রচারে উমরের নীতি ছিল প্রকাশ্য। ইসলামের পতাকা’তলে আসার পর ভূষিত হয়েছিলেন ‘ফারুক’ উপাধিতে।
উমরের ইসলাম ধর্মে দীক্ষা আর অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হতবাক করে দিয়েছিল কোরাইশ’দের। ফলশ্রুতিতে উমর কোরাইশ’দের কাছে মক্কা বিজয়ের আগ অব্দি ছিলেন এক অপ্রতিরোধ্য বিদ্রোহী।
❐ মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত, কিন্তু কেন?
উমরের ইসলাম গ্রহণের পর মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ এবং উনার অনুসারী’রা পবিত্র মক্কা ভূমিতে সর্ব সাধারণের কাছে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলে কোরাইশ’রা তাদের উপর জোড়ালে আক্রমণ আরও বাড়িয়ে দেয়। হামজা, আলী আর উমরের মতো বীর যোদ্ধাদের ইসলামের ছায়াতলে সমাগম’কে কোরাইশ’রা কখনো সহজ ভাবে নেয় নি। যার ভীতি তাদের আর’ও উষ্কে দেয় মুসলিম দের বিরুদ্ধে। কোরাইশ দের তিব্র নির্যাতনের মুখে মুসলিম’রা বাধ্য হয় মক্কা ভূমি ত্যাগ করতে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ এর সিদ্ধান্তে মদিনায় হিজরতের ধারাবাহিকতায় সাহাবী’রা মক্কা ছাড়তে শুরু করেন।
হিজরতের সময় অন্যান্য সাহাবা’রা যখন কোরাইশ অধ্যুষিত “মক্কা” গোপনে ত্যাগ করে’ও পার পাচ্ছিলেন না তখন উমর নাকি প্রকাশ্যে বলে গিয়েছিলেন ”কেউ যদি তার মাকে সন্তানহারা এবং স্ত্রীকে বিধবা করতে চায়, সে যেন আমাকে বাধা দিতে এগিয়ে আসে”। আরব উপ–দ্বীপে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক ক্ষণে উমরের ন্যায় বিপজ্জনক কাজে উদ্যমী হয়তো আর কেউ ছিলেন না যে গুণ তাকে শুরু থেকেই অনন্য করে তুলেছিল!
❐ খলিফা হযরত উমর।
ততো দিনে কেটে গেছে অনেক গুলো বছর স্ব–শরীরে অংশ নিয়েছেন ইসলামের অনেক গুলো যুদ্ধে। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নিজের মেধা,শ্রম,শক্তি,সম্পদ ঘাম আর রক্ত যাই বলেন সবই উজাড় করে দিয়েছেন। ইসলাম’কে দেয়ার বেলায় বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নি, ছিলেন ইসলামের প্রতি এক নিবেদিত প্রান।
খিলাফতের ধারাবাহিকতায় চলে গেছে হজরত আবুবকর রাঃ শাসনামল। ওসমান, আলী সহ সাহাবা’দের সর্বসম্মতি ক্রমে খিলাফতের পরবর্তী গুরুদায়িত্ব আসে উমরের কাধে। ফলশ্রুতিতে উমর ইবনুল খাত্তাব উপবিষ্ট হন ইসলামের ইতিহাসে খুলাফায়ে রাশেদিনের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে।
আমর ইবনে আল আস, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, আবু ওবায়দা আর খালিদ বিন ওয়ালিদের মতো অদম্য যোদ্ধাদের নিয়ে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ দশ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে পারস্য আর রোমের মতো সাম্রাজ্য’কে গুটিয়ে দিয়ে ইসলামি সাম্রাজ্য’কে এক শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করে গেছেন খলিফা উমর।
❐ পারস্য বিজয়ের নেপথ্যে উমর ইবনুল খাত্তাব।
আজকের দিনের ইরাক তখনো পারস্য সাম্রাজ্যের অধিনে যদি বলেন ভৌগলিক কারন তবে, মুসলিম দের এই অঞ্চলে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী’ই ছিল তবে এর ব্যুৎপত্তি অতটা সহজ ছিল না।
পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে মুসলিম দের বিরোধ অনেক আগ থেকেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ এর দূতকে তাচ্ছিল্য কিংবা আবুবকরের আমলে মুসলিম সাম্রাজ্যে বিদ্রোহীদের উস্কানি, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কিংবা ভৌগলিক সব গুলো কারণ’ই সমান ভাবে তরুণ মুসলিম সাম্রাজ্যে’কে পরবর্তী কালে পারস্যের বিরুদ্ধে অনেক গুলো যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল।
আদতে,
পারস্য বিজয় ছিল অনেক গুলো যুদ্ধের যোগফল
সকল যুদ্ধে উমরের বাহিনী নিরন্তর বিজয়ের স্বাধ পায়নি....। তবে বিচ্ছিন্ন বিজয়ের তৃপ্তি’ও কম ছিলেনা, মুসান্নার নেতৃত্বে বুওয়ায়েবের যুদ্ধে বিজয় মুসলিম দের এনে দিয়েছিল বিস্তৃত ভূভাগ, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের নায়কতায় কাদেসিয়ার যুদ্ধে মুসলিম দের ত্রিশ হাজার সৈন্যের বিপরীতে এক লক্ষের বেশি সৈন্য নিয়ে পরাজয়ের স্বাধ পায় রুস্তমের পারস্য বাহিনী।
ফলশ্রুতি’তে টাইগ্রিস নদীর পশ্চিম তীর অব্দি চলে আসে উমরের দাপট। উল্লেখ্য কাদেসিয়ার যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পারস্য সাম্রাজ্যে’কে এক প্রকার পঙ্গু করে দিয়েছিলেন উমর।
উমরের যুদ্ধ বিজয়ের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় কুফা ও বসরার মতো বিশ্বখ্যাত নগরী।
❐জেরুজালেম বিজয়–
জর্ডান, সিরিয়া, জেরুজালেম আর নীল নদের তীরবর্তী মিশরের বিশাল বেলাভূমি ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে। নিজেদের পবিত্র নগরী কিংবা চিরচেনা বাণিজ্য কেন্দ্র দখলে থাকা মানেই বিশেষ কিছু, হয়তো এরকম কোনও স্বপ্ন উমর’কে তাড়া করেছিল, আর সীমান্ত সংঘর্ষের সুরাহা সে তো স্বপ্ন নয় প্রয়োজন’ও বটে। উমরের পদক্ষেপ সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। উমর দেখতে পেতেন তার যোদ্ধারা আত্নপ্রত্যয়ে টইটুম্বুর উনি দেখতেন আবু ওবায়দা’কে, আমর ইবনে আল আস’কে, খালিদ বিন ওয়ালিদ’কে, সুরাহ বিল’কে যেনো একঝাঁক সিংহ ! আদেশ আরোপ করলেই পাহাড় গুড়িয়ে দেবে, সাগরের ঢেউ রুখে দেবে মহাপ্লাবন ফিরিয়ে দেবে। ইয়ারমুকের যুদ্ধ, সিরিয়া’য় অভিযান, জর্ডান বিজয়, জেরুজালেম অধিকার এসবের ব্যাতিক্রম ছিল না! জানা যায় ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর প্রায় তিন হাজার সৈন্য শাহদত বরণ করেন এবং রোমানদের এক লক্ষের কাছাকাছি সৈন্য নিহত হয়। বিজয় অভিযানের ক্রমিকে উমর ইবনুল খাত্তাব লেবানন, আলেপ্পো আর এন্টিওক নিজের হস্তগত করে নেন। এদিকে আমর, মসজিদ আল আকসার শহর জেরুজালেম অবরুদ্ধ করে বসেন উপায়ন্তর না পেয়ে তখনকার শাসক আত্নগোপন করেন এবং জেরুজালেমের প্রধান ধর্ম যাজক সফ্রেনিয়াস স্বয়ং উমরের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রশ্নে আত্নসমর্পণের শর্ত জুড়ে দেন। খবর পৌছে গেল উমরের কানে, যে জেরুজালেমের জনগন সরাসরি খলিফার কাছে ক্ষমতা অর্পণ করতে চায়, খবর পেয়েই উমর ছুটলেন জেরুজালেমের পাণে সে তো শহর নয় একটা স্পন্দন একটা অনুভূতি যে অনুভূতি স্মৃতি কাতরতার। একজন পরিচারকের সাথে উট নিয়ে রওনা হলেন, খানিকটা পথ অতিক্রমের পর উট থেকে নেমে পরিচারক কে বললেন তুমি ওঠো আমি উট টেনে নিয়ে যাচ্ছি, ক্লান্ত হওয়ার পর আবার উঠলেন, পালাক্রমে জেরুজালেম পৌছানোর আগে পরিচারক ছিল উটের পিঠে, হতবাক সবাই সাক্ষী হলো এক অহংবোধ হীন শাসকের! তিনিই এখন, জেরুজালেমের অধিপতি অথচ নেই কোন জাকজমক পূর্ন আয়োজন আহ, ! কি সাদামাটা জীবন শৈলী! সফ্রেনিয়াস বাকরুদ্ধ,ইনিই বুঝি এদের খলিফা! শহরে ঢুকে’ই সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করলেন উমর ইবনুল খাত্তাব। ঘুরে দেখলেন পুরো শহর। জানা যায়, সফ্রেনিয়াস নাকি নিজেদের গির্জায় উমর রাঃ’কে নামাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কিন্তু উমর তা আর পড়েন নি উনি বলেছিলেন আমি যদি এখানে নামাজ পড়ি মুসলিম’রা পরবর্তী কালে এই গির্জা গুড়িয়ে দিয়ে মসজিদ বানিয়ে ফেলতে পারে । তাই অন্যথায় পড়বেন। হতবাক সফ্রেনিয়াস সেদিন সাক্ষী হয়েছিলেন এক ইতিহাস খ্যাত মহানুভবতার।
❐ জীবনের শেষ দিন গুলো –
৬৪৪ সালের এক ভোরে মসজিদে নববীতে ফজরের নামাজের ইমামতি’তে থাকা অবস্থায় পারস্যের এক আততায়ী’র হাতে ছুরির আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন উমর ইবনুল খাত্তাব। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও ভোগবিলাস আর আড়ম্বরতা’কে উপেক্ষা করে গেছেন উমর। পরেছেন তালিযুক্ত জামা। ইসলামী সাম্রাজ্যের দুঃসময়ে আধারে আলো’র মশাল হয়ে পথ দেখিয়ে গেছেন আজীবন ।
উমর রাঃ জীবনের গুটিকয়েক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি বস্তুত উনার জীবনের পরিসংখ্যান আরো বিশাল এই কয়েক লাইনে হয়তো কখন’ও সম্ভব নয়।
লিখেছেন— Nur Ahmed