জন্মঃ
৭৮০ ঈসায়ীর দিকে তিনি তৎকালীন আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের খাওয়ারেজম প্রদেশের আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়া নদীর একটি দ্বীপের নিকটে অবস্থিত খিভা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন, যেটি বর্তমানে আধুনিক উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তার জন্মস্থানের নামানুসারে তাকে ‘আল-খাওয়ারিজমী’ নামে ডাকা হত। খোয়ারিজম নামক শহরে। এই শহরটি প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল যার তৎকালীন নাম ছিল উরগেঞ্চ।
তার পুরো নামঃ
আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি।
ইউরোপে আল-খাওয়ারিজমী ‘আলগোরিজমি’ হিসেবে পরিচিত, যা থেকে পরবর্তীতে ‘আলগরিদম’ শব্দটির উদ্ভব। আলগরিদম কম্পিউটার সফটওয়ারের পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আলগরিদমের সাহায্যেই কম্পিউটারের বাইনারী গণনা সম্পন্ন্ হয়।
আল-খাওয়ারিজমীর গণিতের মৌলিক গবেষণার উপর ভিত্তি করেই আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।
আবার তার নামের খারিজমি (খোয়ারিজমি) অংশটি থেকেই স্প্যানিশ ‘গুয়ারিজমো’ শব্দটির প্রচলন যার অর্থ ‘ডিজিট’ বা সংখ্যা।
কর্মজীবনঃ
তার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন তা ও নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তার নাম থেকে অনুমান করা হয় যে তিনি সম্ভবত আব্বাসীয় শাসনামলে খোরাসান প্রদেশের খোয়ারিজমী (খিভা) হতে আগমন করেন। (বর্তমানে উজবেকিস্থান এর জরাজম প্রদেশ)।
তবে কর্মজীবনের শুরুতে আল খোয়ারিজমী খলিফা আল মামুনের বায়াতুল হিকমাহ সংলগ্ন গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিকে চাকুরী করতেন। তিনি বাগদাদে খলিফা আল-মামুন এর গ্রন্থাগারে প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসাবে কর্মরত ছিলেন, এবং সেখানে তিনি বিজ্ঞান ও গণিত চর্চা করতেন। এখানে বসেই তিনি গ্রিক ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত অনেক বৈজ্ঞানিক রচনা অনুবাদ করেন।
বীজ গণিতে অবদানঃ
বীজগণিত হল ইসলামী সভ্যতায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। বীজগণিতকে তিনিই প্রথম গণিতশাস্ত্রের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলেন এবং এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ভারতীয়রাই প্রথম বীজগণিত নিয়ে গবেষণা করে এবং গ্রিকদের মধ্যে কেবল ডায়োফ্যান্টাস ব্যতীত আর কাউকে বীজগণিত নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করতে দেখা যায়নি। ভারতীয়দের গাণিতিক উৎকর্ষের সময়টা অনেক প্রাচীন ছিল। সুতরাং খাওয়ারিজমির সময় বীজগণিতের অবস্থা ছিল ম্রিয়মান। এ সময় তিনি বীজগণিতের ভিত্তি স্থাপন করে আধুনিক গণিতের পথকে অনেকটাই কুসুমাস্তীর্ণ করে তোলেন। এ কারণেই তাঁকে বীজগণিতের ‘জনক’ বলা হয়।
বীজগণিতে তার প্রধান সাফল্য ছিল বর্গের সাহায্যে দ্বিঘাত সমীকরণের সমধান, এর জন্য তিনি জ্যামিতিক প্রমাণ প্রদান করেন।তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ’। গ্রন্থটির নামানুসারে ইউরোপীয়রা বীজগণিতের শাস্ত্রকে আল-জেবরা নামকরণ করে। আল খাওয়ারিজমি গ্রন্থটিতে আট শতাধিক উদাহরণ যুক্ত করেন। আবিষ্কার করেন সমীকরণের সমাধান করার ছয়টি নিয়ম। ‘কিতাবুল হিসাব আল আদাদ আল হিন্দি’ তাঁর পাটিগণিতবিষয়ক গ্রন্থ।
তাঁর গণিতশাস্ত্রের মাধ্যমে উমর খৈয়াম, লিওনার্দোসহ আরো অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন।
পাটিগণিতে অবদানঃ
খাওয়ারিজমি পাটিগণিতেও অসামান্য পারদর্শী ছিলেন। আরবরা আবিষ্কার করেন শূন্য (০) সংখ্যা বা অঙ্কটি ।এটা ছিল এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এই ‘শূন্য ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করেন। তার শূন্য ব্যবহারের নীতি-ব্যাখ্যা শূন্য’ ব্যবহারকেই দ্রুত করে তােলে। এর ফলে গণিত এসে দাঁড়ালে তার পরিপূর্ণ প্রেক্ষিতে।তার মাধ্যমেই ইউরোপ শূণ্যের ব্যবহার শিক্ষা লাভ করে।
শূন্য বোঝাতে তিনি গোল বৃত্ত ব্যবহার করলেন, যাকে আজ আমরা শূন্য (০) বলে চিনি। তারপর এর নাম দিলেন ‘সিফর’।
ভূগোলে অবদানঃ
তার রচিত সুরত-আল-আরদ (The image of the Earth) । পৃথিবীর বর্ণনা বইটি ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে লেখেন মুসা আল খারিজমি। গ্রন্থটি বিশ্বের প্রথম মানচিত্র হিসেবে বিবেচিত।
‘জিওগ্রাফী’ নামে পরিচিত এই বইটি টলেমির ‘জিওগ্রাফী’র উপর ভিত্তি করে রচিত। বইটিতে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের ভিত্তিতে আবহাওয়া অঞ্চল ভাগ করা হয়েছে। টলেমির কাজের উপর ভিত্তি করে রচনা করলেও খারিজমি টলেমীর ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগর সম্বন্ধীয় টলেমির ভুলগুলো সংশোধন করেন। সুরত আল আর্দের একটি কপি বর্তমানে ফ্রান্সের স্ট্র্যাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
ত্রিকোনোমিতিতে অবদানঃ
আল খোয়ারিজমি রচিত জিজ আল সিন্দ-হিন্দে ত্রিকোণমিতি নিয়ে কম কাজ থাকলেও তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই বইয়ে ত্রিকোণমিতিক ফাংশন সাইন এবং কোসাইন-এর অনুপাত নির্ণয় করে এগুলোকে তার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবিলে সংযুক্ত করেন। গোলকীয় ত্রিকোণমিতি নিয়েও খোয়ারিজমির একটি বই রয়েছে।
আল খোয়ারিজমি রচিত জিজ আল সিন্দ-হিন্দে বা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল টেবিলস অব সিন্দ অ্যান্ড হিন্দ’-এর স্প্যানিশ অনুবাদও করেন সেই দার্শনিক ভদ্রলোক, অ্যাডিলার্ড অব বাথ। এই অনুবাদের চারটি কপির দুটি ফ্রান্সে, একটি মাদ্রিদে এবং একটি অক্সফোর্ডে সংরক্ষিত আছে।
জ্যোতির্বিদ্যায় তার অবদানঃ
জ্যোতির্বিদ্যায় তার অবদান উল্লেখযোগ্য এবং দিয়ে গেছেন নতুন ধারণা ও প্রজ্ঞার জগতে।তার আরও কাজের মধ্যে ঘড়ি ও সূর্যঘড়ির ক্ষেত্রে তার অবদান অন্তভূক্ত। আল-খাওয়ারিজমী জ্যোতির্বিজ্ঞানের একখানা জিজ বা তালিকা প্রণয়ন করেন। তার এই জিজের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঔপপত্তিক উপক্রমণিকা সংযোগ করেন। এ বিষয়ে এ উপক্রমণিকাই তার প্রগাঢ় পান্ডিত্যের স্বাক্ষর।
এ সম্পর্কিত তার দুই খানা গ্রন্থ রয়েছে। প্রথম গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্রপাতির নির্মাণ কৌশল আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় গ্রন্থে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কিরুপে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ নিতে হয তা সম্পর্কে আলোচনা করেন।জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলো অনুবাদ করা হয ইউরোপীয় ভাষায় ।পরবর্তীতে এগুলো চীনা ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়।
জ্যামিতিতে তার অবদানঃ
তিনি প্রথম বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন। জ্যামিতির ক্ষেত্রে আয়ত,বর্গ,ত্রিভুজ প্রভৃতি জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলোর যে ধারণা দিয়েছিলেন তা হুবহু আজও একই রকম রয়েছে। তিনিই কনিক সেকশনের গাণিতিক ধরণের আধুনিকায়ন করেন।
ইহুদী বর্ষপঞ্জি সম্পাদনাঃ
হিব্রু বর্ষপঞ্জি নিয়ে খোয়ারিজমি 'রিসালা ফি ইসতিখরাজ তারিখ আল ইয়াহুদ (Extraction of the Jewish Era) শিরোনামের একটি বই রচনা করেন। সপ্তাহের কোন দিন মাসের প্রথম দিন হবে বা তিশ্রি’ নির্ণয়ের উপায় বর্ণনা করেনতা ।
এছাড়াও ইহুদি বর্ষ বা ‘অ্যানো মুন্ডি’ এবং ‘অ্যানো গ্রেকোরাম’ বা গ্রীক বর্ষের মধ্যকার বিরামকাল তিনি নির্ণয় করেন। হিব্রু পঞ্জিকা ব্যবহার করে সূর্য ও চাঁদের দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করা নিয়েও এতে আলোচনা আছে।
যেখানে শুধুমাত্র খাওয়ারিজমীঃ
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিন্দু গণিতবিদগণ দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। হিন্দুদের উদ্ভাবিত এই দশমিক পদ্ধতি খারিজমিই প্রথম ইসলামী জগতে নিয়ে আসেন। তার রচিত The Book of Addition and Subtraction According to the Hindu Calculation (যোগ-বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) তারই উদাহরণ।
আরবি ভাষায় তার রচিত গ্রন্থই সর্বপ্রথম ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতায় ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমেই তার গবেষণার বিকাশ ঘটে। অ্যালগরিদম উৎপত্তিই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
তার রচিত পুস্তক কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবলা হতে বীজগণিতের ইংরাজী নাম আলজেবরা উত্পত্তি লাভ করে।
Algorithm শব্দটি Alkhwarizmi নামের ল্যাটিন অপভ্রংশ algorismi হতে উত্পত্তি লাভ করেছে।
আরও কিছু গ্রন্থাবলীঃ
কিতাব আল-জাম ওয়াল তাফরিক-বিল-হিসাব আল হিন্দ: এই বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিন্ত এই বইটি আরবীতে আর পাওয়া যায় না। কিতাব আল-রুখমাত: এটি সুর্যঘড়ির উপর লিখিত একটি বই। এটি থেকেও আমরা বঞ্চিত।
আল খারিজমির যে সকল কাজের পাণ্ডুলিপি আজ অবধি সংরক্ষিত আছে সেগুলো বাদেও তার আরো বেশ কিছু কাজ রয়েছে বলে ধারণা করেন ঐতিহাসিকগণ। তার মধ্যে ‘কিতাব আল তারিখ’ বা ‘বর্ষপঞ্জির বই’ অন্যতম। দার্শনিক ইবনে আল নাদিমের ‘কিতাব আল ফিরিস্ত’-এর মধ্যে মুসা আল খারিজমির একটি বইয়ের তালিকা দেয়া আছে যাতে ‘কিতাব আল তারিখ’ এর কথা উল্লেখ আছে। অতএব এই পুস্তিকাটি যে খারিজমি লিখেছিলেন সে সম্পর্কে অধিকাংশ ইতিহাসবিদগণই একমত প্রকাশ করেন। তাছাড়াও আরো কিছু বইয়ের কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ লিখে গেছেন যেগুলো আল খারিজমির কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
মৃত্যুঃ
খলিফা আল মামুনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর (আনুমানিক ৮৫০ খ্রীষ্টাব্দে) আল খোয়ারিজমির মৃত্যু হয়।
তথ্য সূত্র—
১. বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৫ই আগস্ট ২০২১
২. বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ সেপ্টেম্বর ২০২১
৩. মুসলিম ব্যক্তিত্ব ব্লগপোস্ট
৪. Batoppers blog
৫. উইকিপিডিয়া
লিখেছেন— Raqib Hussain